ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১

করেনাভাইরাস: সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা কি বাকি বিশ্বের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে

বিশ্ব ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০২০ এপ্রিল ১৩ ২১:১৩:৫৭
করেনাভাইরাস: সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা কি বাকি বিশ্বের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে

বৃহস্পতিবারে একদিনে সে দেশে নতুন ২৮৭ জন করোনারোগী শনাক্ত করা হয়, যেখানে তার আগের দিনের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪২।

নতুন এই সংক্রমণ প্রধানত হচ্ছে অভিবাসীদের কলোনিগুলোতে যেখানে অল্প জায়গার মধ্যে অনেক মানুষ বলতে গেলে গাদাগাদি করে থাকে। ফলে এতদিন লকডাউনের পথ পরিহার করলেও, সিঙ্গাপুরকে এখন বাধ্য হয়ে আংশিক লকডাউন করতে হচ্ছে।

স্কুল বন্ধ করা হয়েছে, এবং জরুরি নয় এমন সব ব্যবসা প্রতিষ্টান বন্ধ করা হয়েছে। মানুষজনকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

করোনাভাইরান সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের অন্যতম ধনী এই দেশটি যা করছিল, তাকে এতদিন পর্যন্ত আদর্শ মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু গত কয়েকদিনের পরিস্থতি দেখে এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে।

ভালো কী হচ্ছিলো সিঙ্গাপুরে?সিঙ্গাপুরে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয় একেবারে গোড়ার দিকে। ২৩শে জানুয়ারি চীনের উহান থেকে একজন চীনা পর্যটক এই ভাইরাস বয়ে নিয়ে আসেন। ঐ দিনেই উহানে পুরো লকডাউন করা হয়েছিল।

রোগটি কোভিড-১৯ নাম পাওয়ার আগেই তা সিঙ্গাপুরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই তা ঠেকানোর জন্য নানামুখি ব্যবস্থা শুরু হয়।

বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু হয়। এছাড়া, যার শরীরেরই কোনো উপসর্গ দেখা গেছে, সাথে সাথে তাকে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় যারা পজিটিভি হয়েছে, তাদের সংস্পর্ষে আসা লোকজন খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিন করা হয়।

সে সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান এমন মন্তব্যও করেছিলেন যে সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যান্য সরকারগুলোর জন্য পথপ্রদর্শক হতে পারে।

কয়েক সপ্তাহ ধরে সিঙ্গাপুর নতুন সংক্রমণের সংখ্যা ছিল খুবই কম। সহজে নতুন রোগী শনাক্ত করে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছিল তারা।

ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ততটা বিঘ্নিত করার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারি সতর্কীকরণ নেটওয়ার্কের প্রধান এবং সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেল ফিশার বিবিসিকে বলেন, মানুষজন যখন বলছিল সিঙ্গাপুর খুব ভালো কাজ করছে, আমার উত্তর ছিল, “এখন অবধি।“

“এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন,“ তিনি বলেন।

পরিস্থিতি কখন খারাপ হতে শুরু করে?মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে পরিস্থিতি আয়ত্বের মধ্যে ছিল, বলছেন সিঙ্গাপুরের স্য সুই হক স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন অধ্যাপক ইক ইন টিও।

ততদিনে বিশ্বেজুড়ে এই রোগ কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তা পরিষ্কার হতে শুরু করে। দেশে দেশে জনসাধারনকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় পড়ে যায়।সিঙ্গাপুরের অনেক নাগরিক যারা অন্যান্য দেশে ছিলেন তারা ভয়ে হাজারে হাজারে দেশে ফিরতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে শ পাঁচেকেরও বেশি মানুষ শরীরে বয়ে নিয়ে আসেন করেনাভাইরাস।

তখনই বিদেশ ফেরতদের জন্য ১৫ দিন ঘরে কোয়ারেন্টিনে থাকা বাধ্যতামুলক করা হয়। কিন্তু পরিবারের অন্যদের ওপর কোনো বিধিনিষেধ জারি করা হয়নি। বাড়তে থাকে সংক্রমণের মাত্রা। মার্চের মাঝামাঝিতে নতুন সংক্রমণ হতে থাকে প্রতিদিন কয়েক ডজন করে। অধিকাংশই বিদেশ ফেরত অথবা তাদের সাথে সম্পর্কিত।

তখনই প্রথম সংক্রমণের ওপর নজরদারী করা কঠিন হয়ে পড়তে শুরু করে।

অধ্যাপক টিও বলেন এমন সমালোচনা করা সহজ যে বিদেশ ফেরত নাগরিকদের মেলামেশার ওপর যথেষ্টা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি, “কিন্তু এটা সত্য যে এখন আমরা এই রোগ সম্পর্কে যতটা জানতে পারছি, মার্চ মাসে সেই তথ্য ততটা ছিলনা।“

“এখন আমরা জানি যে উপসর্গ না থাকলেও কোনো ব্যাক্তি এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। এবং সম্ভবত এ কারণেই রোগটি এতটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে,“ বলেন প্রফেসর টিও।

ঐ বিশেষজ্ঞ সাবধান করেন, এখন পর্যন্ত যে সব তথ্য মানুষের কাছে আছে তার ওপর একশ ভাগ নির্ভর করা ঠিক হবেনা। যেমন, তিনি বলেন, যাদের একবার কোভিড-১৯ হয়েছে তাদের আর কখনো হবেনা - এই ধারণা সত্যি নাও হতে পারে।

সিঙ্গাপুরে কোথায় কোথায় ভাইরাস ছড়িয়েছে?বিদেশ থেকে ভাইরাস শরীরে বয়ে এনে ছড়ানো ঠেকাতে, বিদেশ ফেরত সমস্ত লোকজনকে এখন পরিবারে না রেখে সরকারি কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রে রাখা হচ্ছে। এখন অবশ্য খুব কম মানুষই সিঙ্গাপুরে ঢুকছে, ফলে সরাসরি তাদের মাধ্যমে সংক্রমণের সংখ্যাও এখন দ্রুত পড়ে গেছে।

মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে নতুন একটি আইন জারি করা হয়েছে যার অর্থ, মুখে না বললেও, দেশব্যাপী আংশিক লকডাউন। জরুরি কাজ ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে গেলে ১০,০০০ সিঙ্গাপুর ডলার পর্যন্ত জরিমানা বা ছয় মাসের জেল হতে পারে।

অধ্যাপক টিও এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন, এবং বলেন তারপরও সামনের দিনগুলোতে হয়ত সংক্রমণের সংখ্যা বেশি হতে পারে, কিন্তু এটা কাজে দেবে।

কিন্তু গত সপ্তাহে যে হারে সংক্রমণ সিঙ্গাপুরে বেড়েছে তার সিংহভাগ শিকার হয়েছে সেখান অভিবাসী শ্রমিকরা। লাখ লাখ এসব শ্রমিক সেখানকার নির্মাণ শিল্প, শিপিং এবং রক্ষনাবেক্ষণে কাজ করে। অর্থনীতি সচল রাখতে সিঙ্গাপুরকে এদের ওপর নির্ভর করতেই হবে।

কিন্তু যেসব জায়গায় এই অভিবাসী শ্রমিকরা কাজ করে বা থাকে, তাদের পক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব।আইন অনুয়ায়ী এই শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট কিছু হস্টেল বা ডরমিটরিতে থাকতে হয়।

বেসরকারিভাবে পরিচালিত এসব অনেক ডরমিটরিতে এক ঘরে ১২ জন পর্যন্ত শ্রমিক থাকে। এরা বাথরুম, রান্নাঘর এবং আরো অনেক কিছু শেয়ার করে।

ফলে, এসব শ্রমিক ডরমিটরি যে করেনাভাইরাসের ক্লাস্টারে পরিণত হবে, তা বলাই বাহুল্য, এবং হয়েছেও তাই।প্রায় পাঁচশ কোভিড-১৯ কেস পাওয়া গেছে এরকম কয়েকটি শ্রমিক ডরমিটরিতে।

সিঙ্গাপুরে এখন পর্যন্ত যত রোগী শনাক্ত হয়েছে তার ১৫ শতাংশই এসেছে এরকম একটি মাত্র ডরমিটরি থেকে।অনেক শ্রমিক উপসর্গ নিয়েও কাজ করতে গেছে।আর এ কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামি সপ্তাহে বা তারপর সিঙ্গাপুরে সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বাড়বে, অনেক নতুন রোগী তৈরি হবে।

অন্যান্য দেশের জন্য শিক্ষাপ্রফেসর টিও বলেন, “সিঙ্গাপুরে শ্রমিক ডরমিটরিতে যা হয়েছে, সেটা অন্যান্য অনেক দেশেও ঘটতে পারে।, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত বা মধ্যমাপের অর্থনীতির দেশগুলোতে।

“দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে এমন সব জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা ডরমিটরির জীবনের মতো গাদাগাদি করে বসবাস করে।“

তিনি বলেন, গাদাগাদি করে বসবাস করার কারণে নিয়ন্ত্রণহীন সংক্রমণ ঠেকাতে কী করা যেতে পারে সে ব্যাপারে সরকারগুলোকে দ্রুত স্বচ্ছতার সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রফেসর টিও‘র সহকর্মী প্রফেসর লি ওয়াং সু বলেন, সিঙ্গাপুরের ঘটনা সামজিক এবং শ্রেনী বৈষম্যের বাস্তবতাকে নগ্ন করে দিয়েছে যেটা সরকারগুলোর জন্য আরেকটি শিক্ষা হতে পারে।

“এই ভাইরাস আমাদের সমাজের দুর্বল দিকগুলো খুব পরিষ্কার করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে - অভিবাসী শ্রমিকদের পরিস্থিতি তারই একটি জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।“

প্রফেসর সু বলেন, সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করেই এইসব ডরমিটরি তৈরি করেছে, কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি প্রমাণ করেছে সেসব মান যথেষ্ট নয়।

সিঙ্গাপুরের শ্রমশক্তি বিষয়ক মন্ত্রী জোসেফিন টিও এসব শ্রমিক ডরমিটরির মান বাড়ানোর অঙ্গিকার করেছেন। তিনি বলেন, “এটি করা সঠিক।“

সিঙ্গাপুর কি প্রমাণ করছে যে এই ভাইরাস আটকানো সম্ভব নয়?যদিও এখন সমালোচনা হচ্ছে যে সিঙ্গাপুর এমনকী আংশিক লকডাউন জারি করতেও সময় নিয়েছে, কিন্তু প্রফেসর ফিশার বলছেন, অন্য দেশগুলোর তুলনায় সিঙ্গাপুর অনেক আগেই ব্যবস্থা নিয়েছে। যখন প্রতিদিন নতুন সংক্রমণের সংখ্যা একশরও নীচে, তখনই তারা আংশিক লকডাউনের পথে গেছে।

কিন্তু ঐ বিশেষজ্ঞ বলেন, লকডাউন কার্যকরি করতে হলে তিনটি বিষয় ঘটতে হবে - প্রথমত, সংক্রমণ বন্ধ করতে সব মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত: স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সচল রাখতে তাদেরকে সময় দিতে হবে, নতুন রোগীদের জন্য বেড প্রস্তুত করতে এবং ডাক্তার-নার্সদের বিশ্রাম নেওয়ার সময় দিতে হবে।

এবং তৃতীয়ত সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখতে হবে - আইসোলেশনের স্থান, আইন, সংক্রমিত লোকদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়া।

“আপনি যদি একটি বা দুটি কাজ নিশ্চিত করেন আর অন্যটি অবজ্ঞা করেন, দুর্যোগ নতুন করে ফরে আসবে।“

তবে ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সিঙ্গাপুরের পরিস্থিতি অনেক ভালো। তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রোগীর চাপে ভেঙ্গে পড়ছে না। সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ নেই, মিডিয়ারও চাপ নেই।

কিন্তু প্রফেসর ডেল বলেন, যদিও সেখানে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা রয়েছে এবং সরকার যথেষ্ট তথ্য মানুষকে দিচ্ছে, তারপরও “সাধারণ জনগণের সবাই তাদের নিজস্ব ভূমিকা এবং দায়িত্ববোধ নিয়ে সমানভাবে সচেতন নয়।“

“তারা হয়ত ভাবছে - হ্যাঁ সিঙ্গাপুরের এটা করা উচিৎ, কিন্তু আমি আমার মাকে দেখতে যাবো।“

একারণে লকডাউন জারির পর প্রথম দুই দিনেই সিঙ্গাপুরে নির্দেশ লঙ্ঘনের জন্য ১০ হাজার মানুষকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের মত এত ছোট, স্থিতিশীল এবং উন্নত দেশের পরিস্থিতিও যেখানে এমন, সেখানে বড় এবং অনেক জটিল দেশগুলোর পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অনেক কঠিণ হবে। ফল পেতে তাদের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।

অনেক দেশই আশাবাদী হওয়ার লক্ষণ দেখছে. কিন্তু সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা পরিষ্কার বলে দিচ্ছে - আত্মপ্রসাদের বিন্দুমাত্র জায়গা এখনও নেই। বরঞ্চ করোনাভাইরাসের দ্বিতীয়, তৃতীয়, এমনকী চতুর্থ দফার সংক্রমনের জন্য প্রতিটি দেশের প্রস্তুত থাকা উচিৎ। সুত্রঃ বিবিসি

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ



রে