ঢাকা, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রহস্যময় মৃত্যুকুপ চাঁদপুরের তিন নদীর মোহনা

জাতীয় ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০১৯ নভেম্বর ১২ ০০:৫৮:৩৩
রহস্যময় মৃত্যুকুপ চাঁদপুরের তিন নদীর মোহনা

ভয়ঙ্কর ওই ঘূর্ণিপাকে কিছু তলিয়ে গেলে তার আর হদিস মেলে না। যেসব বড় বড় যাত্রীবাহী লঞ্চ তলিয়ে গেছে এখানে, সেগুলোর সন্ধান কোনোদিনই আর পাওয়া যায়নি। চাঁদপুরের তিন নদীর এই স’ঙ্গমস্থল স্থানীয়ভাবে কোরাইল্লার মুখ নামেও পরিচিত।

মোহনাটি নদীর একেবারে তীরে অবস্থিত। সাধারণত নদীর তীর অগভীর থাকে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, নদীর তীরে হওয়া স্বত্ত্বেও এই মোহনা অনেক গভীর। বর্ষাকালে এটি রূপান্তরিত হয় রহস্যময় মৃত্যুকূপে। পানির ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি দেখে মানুষের মনে শিহরণ জাগে। এই মোহনা নিয়ে লোকমুখে অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে।

জনশ্রুতি আছে, এই মোহনা এক ছেলের অভিশাপে সৃষ্টি হয়েছে। সে হয়তো শত বছর আগের কথা। তখন মোহনাস্থলে কোনো নদী ছিল না। ছিল ছোটখাটো বাজার, হোটেল আর দোকানপাট। নদী ছিল কয়েক কিলোমিটার দূরে। একদিন বিকেলে ছোট এক দ্ররিদ্র ছেলে শিশু একটি হোটেলে গিয়ে খাবার চায়। হোটেলের মালিক তাকে তাড়িয়ে দেয়। ছেলেটি পুনরায় খাবার চাইতে গেলে তাকে আবারো তাড়িয়ে দেয়া হয়।

ছেলেটি আবারও ওই হোটেলে যায়। এবার হোটেলের মালিক রেগেমেগে তার গায়ে গরম তেল ছুড়ে মারে। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাদঁতে কাঁদতে ছেলেটি চলে যায়। ওই রাতেই হোটেল অবধি কয়েক কিলোমিটার জায়গা নদীর ভাঙনে পানির অতলে হারিয়ে যায়। তৈরি হয় মোহনা। ওই ঘটনার বহু বছর পর ওই ঘূর্ণিপাকে পড়ে একটি লঞ্চ ডুবে যায়। তখন ডুবুরিরা লঞ্চের সন্ধানে নদীর তলদেশে গিয়ে দেখে একটি ছোট ছেলে চেয়ারে বসে আছে। ঘটনাগুলো আদৌ সত্যি কি-না তা বলা কঠিন।

তবে অবাক করা বিষয় হলো একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে এই ঘূর্ণিপাকে। সেই অতীতকাল থেকে এখন পর্যন্ত এলাকাটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ও জাহাজ চলাচলের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারিভাবেও চাঁদপুরকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে মোহনার চারপাশে এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বৃত্তাকারে খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয়। এখান দিয়েই প্রতিদিন চরাঞ্চলের বহু ট্রলার যাত্রী নিয়ে পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দেয়।

চাঁদপুরে চার উপজেলায় প্রায় ৪০টি চরাঞ্চল রয়েছে। এসব এলাকার লোকজনকে দৈনন্দিন কাজ ও চিকিৎসার জন্য জেলা ও উপজেলা সদরে যেতে হয়। যোগাযোগের একমাত্র বাহন ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলার। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশু, নারী ও পুরুষ সবাই এসব ট্রলারে করে নিয়মিত জেলা সদরে যাতায়াত করেন। ফলে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নিয়মিতই প্রা’ণহা’নির ঘটনা ঘটে।

এই ট্রায়াঙ্গেলে ২৪ ঘণ্টাই প্রবল ঘূর্ণিস্রোত বইতে থাকে। প্রতি সপ্তাহেই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে এখানে। গত ৩০ সেপ্টেম্বরেও মেঘনা-পদ্মা-ডাকাতিয়া নদীর এই মোহনার ঘূর্ণন স্রোতের কবলে পড়ে ভেসে যান পাঁচ জেলে। জানা যায়, তিন নদীর মোহনায় ঘূর্ণন স্রোতে পড়ে জেলেদের নৌকাটি উল্টে যায়। এতে নৌকায় থাকা সাতজন জেলের মধ্যে দুজন সাঁতরে পাড়ে আসতে সক্ষম হন। বাকি পাঁচজনকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। বলা যায়, ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছেন তারা।

মালবোঝাই জাহাজ কিংবা কার্গো ডুবির মতো ঘটনাও ঘটেছে এখানে। আর এসব দুর্ঘটনাজনিত জাহাজের সন্ধান কোনোদিনই আর পাওয়া যায়নি। মোহনায় এত বেশি স্রোত থাকে যে এসব নৌযান উদ্ধার কখনোই সম্ভব হয়নি।

অতীতের দুর্ঘটনার ইতিহাস সম্পর্কে স্থানীয়রা জানান, পাকিস্তান আমল থেকে এখানে বহু যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছে। যার মূল কারণ মোহনার তীব্র স্রোত। এখানে এমভি শাহজালাল, মদিনা, দিনার ও নাসরিন-১ লঞ্চ ডুবে যায়। সবগুলো লঞ্চেই প্রচুর যাত্রী ছিল। তীব্র স্রোতের কারণে অধিকাংশ যাত্রীই বেঁচে ফিরতে পারেননি। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এমভি নাসরিন-১, যার প্রায় ৯০ ভাগ যাত্রীই মা’রা গেছে। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই এমভি নাসরিন-১ লঞ্চ ডুবিতে মা’রা যান ১১০ জন, নিখোঁজ হন ১৯৯ জন। এখন পর্যন্ত এখানে ডু’বে যাওয়া কোনো লঞ্চের সন্ধান পায়নি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ – বিআইডব্লিউটিএ।

বর্তমানে বর্ষার মৌসুম শেষ হলেও নদীর তীব্র স্রোত ও ঢেউ এখনো রয়েছে। আর এরই মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে মালামাল ও যাত্রী বোঝাই করে ট্রলারগুলো তাদের গন্তব্যস্থলে ছুটছে। প্রতিদিনই মালবোঝাই বড় বড় কার্গো কিংবা ট্রালার এ মোহনা পেরিয়ে চাঁদপুরের ব্যবসায়িক এলাকা পুরানবাজারে যায়। স্রোত বৃদ্ধি পেলে মালামাল নিয়ে অনেক নৌযান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। স্রোতের গতিপথ বুঝতে না পেরে অনেক নৌযান দুর্ঘটনার শি’কার হয়।

এই মোহনার পাশ দিয়েই বরিশাল, পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের লঞ্চ চলাচল করে। তিন নদীর এ সঙ্গমস্থল চাঁদপুর জেলা সদরের অন্যতম একটি পর্যটন স্পট। প্রতিদিনই এখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



রে