ঢাকা, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সাবধান মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা

বিশ্ব ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০১৯ ফেব্রুয়ারি ১৪ ০০:৫১:৪৭
সাবধান মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার জনশক্তি রফতানি খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার কথা বললেও বাস্তবতা হলো প্রতিবছরই হাজার হাজার শ্রমিক প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফেরত আসেন। কতজন শ্রমিকের ক্ষেত্রে এমন হয়ে থাকে, তারও কোনো পরিসংখ্যান নেই বাংলাদেশ সরকার ও দূতাবাসের কাছে। এ ধরনের প্রতারণার বিরুদ্ধে শুধু আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়। এখানে দরকার, মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি। একই সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণা রোধে সরকারিভাবে রেজিস্ট্রেশনের যে ব্যবস্থা আছে তা কাজে লাগাতে হবে।

বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, এ ধরনের প্রতারণার বিরুদ্ধে তারা শক্ত আইন প্রণয়নের কাজ করছেন। কাজের জন্য অনেক মানুষ বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যান। এই বিপুল কর্মশক্তির একটি অংশ আবার বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। তাছাড়া তাদের মধ্যে অনেকে অপহরণের শিকার হয়ে মুক্তিপণের মাধ্যমে প্রাণে বেঁচে দেশে আসেন। আবার অনেকে মারাও যান।

১২ ফেব্রুয়ারি দুই বাংলাদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে অপহরণের অভিযোগ পায় মালেয়শিয়া পুলিশ। মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত এই ব্যক্তিদের আটক করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন দুই জন। উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশি এক নাগরিককে। তবে নিহত দুই অপহরণ কারি বাংলাদেশি কিনা এখনও পরিস্কার নয়।

কাজাং ওসিপিডি’র সহকারী কমিশনার আহমেদ জাফির ইউসুফ বলেন, ‘কুয়ালালামপুরের পুলিশ একটি সংঘবদ্ধ চক্রকে ধরার জন্যে ওৎ পেতে ছিলেন। মঙ্গলবার রাতে চেরাসের বাতু ৯ এবং তামান মুদুনের একটি ছোট স্থানে অবস্থান করছিলেন তারা।’

রাত ১ টা ৩৫ মিনিটে পুলিশ বাড়িটিতে অভিযান চালায়। সেখানে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে রাখা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল। অভিযান চলাকালীন সময়ে বাড়িটি থেকে অপহরণকারীরা গুলি ছুড়তে শুরু করে। আত্মরক্ষার জন্যে পাল্টা গুলি ছোড়ে পুলিশ।

জাফির ইউসুফ বলেন, ‘আমরা সফলভাবে অপহরণে আটক ব্যক্তিকে মুক্ত করি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি সেন্তুল থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি ৯এমএম পিস্তল এবং একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে নিহত ব্যক্তিদের কাছ থেকে কোন ধরনের ডকুমেন্টও পাওয়া যায়নি।’

এ ঘটনায় একটি মামলাও করা হয়েছে। ৩০৭ ধারায় পেনাল কোর্টে এই মামলাটির তদন্ত চলছে বলেও জানান তিনি।

মালয়েশিয়ায় প্রতারণার শিকার হয়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর। ২/৩ মাস ভালো বেতন দিলেও কেটে নেয় কমিশনের টাকা। পরবর্তী মাসে পুরো বেতন নিয়ে পালিয়ে যায় তাও আবার বাংলাদেশি। আর এ প্রতারণার অন্তরালে কাজ করছে বাংলাদেশিরাই।

কেউ পারমিট নিয়ে কোম্পানি ছেড়ে বেশি বেতনের আশায় স্ব-দেশির প্ররোচনায় পড়ে পালিয়ে অন্যত্র কাজ করছে। আবার কেউ পারমিট ছাড়াই কাজ করছে, নিজের খেয়াল খুশিতে। বৈধ আর অবৈধ এদের সিংহভাগ লোকই বেশি রোজগারের আশায় বেছে নিচ্ছেন নির্মাণ শ্রমিকের পেশা।

মালয়েশিয়ায় নির্মাণ কোম্পানি নির্ভর্শীল বাংলাদেশি শ্রমিকের উপর। আর এসব কোম্পানির লোক দেখাশুনার জন্য একাধিক লোককে কাপালা (সুপার ভাইজার ফোরম্যন নির্বাচিত করে। প্রতি ১০/২০ জনের গ্রুপে ১ জন করে কাপালা থাকে।

যাবতীয় কাজ দেখাশুনাসহ কাজের হিসাব রাখার দায়িত্ব তার উপরেই থাকেন। আবার এই কাপালা অনেক সময় কমিশন ভিত্তিক লোক সংগ্রহ করে থাকে। কোম্পানি থেকে ৬০ রিঙ্গিত বেসিক (৮ঘন্টা) দেওয়া হলেও কাপালারা ৮/১২% হারে নিজেদের কমিশন কেটে নেয়। পাশাপাশি সুযোগ বুঝে সাধারণ শ্রমিকের ২/৩ মাসের বেতন নিয়ে চম্পট দেয় নিজ গন্তব্যে। এতে পুলিশ রিপোর্ট ছাড়া কোম্পানির কিছুই করার থাকেনা। আর এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে জহুরবারু ফরেস্ট সিটি নামক বৃহত্তম ঐ প্রজেক্টে।

ফরেস্ট সিটির প্রতিটা দোকানেই এমন অনেক লিফলেট দেখা যায়,অমুক কে ধরিয়ে দিন ৫ হাজার রিঙ্গিত (১ লক্ষ টাকা) পুরস্কৃত করা হবে। ১০ হাজার রিঙ্গিত(২ লক্ষ টাকা) পুরস্কৃত করা হবে। বাংলা ভাষার সঙ্গে মালয় ভাষায় লেখা একাদিক লিফলেট চোখে পড়ে। প্রতারিত কয়েক জনের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেছে, প্রথম ২/৩ মাস ভালোভাবে বেতন দিলেও পরেই আর সম্পূর্ণ বেতন দেয়না। বিভিন্ন অজুহাতে কাটা হয় কমিশন।

ভুক্তভোগীদের একজন মামুনের কাছে জানতে চাইলে মামুন বলেন, এইসব ব্যপার হাইকমিশনের পরামর্শক্রমে পুলিশ রিপোর্ট করেছি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আমার মত অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়ে চুপ করে বসে থাকতে হচ্ছে। মামুনের ভাষ্যমতে হাইকমিশনের মধ্যমে বাংলাদেশ প্রশাসনকে অবগত করলে দেশে গিয়েও এ প্রতারক চক্র পালাতে পারবে না।

অন্যদিকে, মালয়েশিয়ায় সচেতনতামূলক প্রচারণায় ভুলের বৃত্ত থেকে বের করে আনতে পারে বাংলাদেশিদের এমন মন্তব্য করেছেন দেশটিতে কর্মরত সচেতন রেমিট্যান্সযোদ্ধারা।

মালয়েশিয়ার ১৩টি প্রদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের রেমিট্যান্সযোদ্ধারা। আর এ যোদ্ধারা আধুনিক মালয়েশিয়া গঠনেই নিরলস কাজ করে চলেছেন। কুয়ালালামপুরের টুইন টাওয়ার, পেনাংয়ের বাতুফিরিঙ্গি সৈকত, তেরেঙ্গানুর মসজিদ, মেলাকার মালয় রেস্তোরাঁ, পাহাঙ্গের চা বাগান, পেরাকের রাবার বাগান, জহুর বারু, লংকাউই দ্বীপ- কোথায় নেই বাংলাদেশিরা। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে বাংলাদেশিরা মালয়েশিয়ায় বসবাস করলেও তাদের ঘামের-পরিশ্রমের সুফল বেশ ভালোভাবেই নিচ্ছে ভারত মহাসাগর বুকের দেশটি।

এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ মালয়েশিয়ায় এসে আবার কেউ ফেরত গেছে- এমন ঘটনা বিরল। বাংলাদেশিরাও খুব কম সময়েই মালয় ভাষা ও সংস্কৃতি আয়ত্ত করে এখানে দিনাতিপাত করছেন। গড়ছেন দেশের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ।

এতসব ভালো খবরের মধ্যেও মাঝেমধ্যে কিছু খবর পীড়া দেয় বাংলাদেশিদের। সেখানে অবস্থানের কাগজপত্রের ব্যাপারে অসতর্কতা অথবা খানিক ভুল কিছু লোককে হয়রানি এমনকি শাস্তির মুখেও ফেলে দেয়। আবার কতিপয় অসাধু চক্রের অসৎ কর্মের কারণে পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটিকেই অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়। সচেতন মহলের মতে, একই ভুল বারবার করার পরও সচেতনতা না আসায় বাংলাদেশিদের এ অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে বারবার পড়তে হয়।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অসাধু চক্রের অসৎ কর্মের ফলশ্রুতিতে সামগ্রিকভাবে হয়রানির শিকার হওয়া অনেক বাংলাদেশিকে এটিএম বুথ হিসেবেও বিবেচনা করে ওই। তারা খুব সহজেই বাংলাদেশিদের ভুলের মাশুল হিসেবে জরিমানা স্বরূপ বিরাট অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়। এমনও অভিযোগ আছে, বাংলাদেশি জিম্মি করে আটকদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে তারপর ছেড়ে দেয়।

এজন্য দায়টা বেশি কাদের? বলা যায়, শ্রমিক আইন এবং সাধারণ নিয়ম-কানুনের অজ্ঞতার জন্যই এভাবে ভুগতে হচ্ছে বেশিরভাগ বাংলাদেশিদের। কারও কারও অসদুপায় অবলম্বনের কারণে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে হয় অনেককে।

জানা গেছে, বিভিন্ন সংগঠন নেপালি, ইন্দোনেশিয়ান, ফিলিপিনো, থাই প্রবাসীদের জরুরি বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন রাখতে প্রচারণা চালায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণার পাশাপাশি বিভিন্ন গঠনমূলক অনুষ্ঠান ও বিদেশের মাটিতে অবস্থানকালে দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে ওইসব দেশের নাগরিকদের সচেতন করা হয়।

কিন্তু বাংলাদেশিরা এ ধরনের সচেতন বার্তাই পান না। অবশ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে কোনো সংগঠন না থাকলেও মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের রয়েছে সর্বাধিক রাজনৈতিক সংগঠন! বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক থেকে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশিদের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু তাদের সেই ভূমিকার গুরুত্বটা কথায় থেকে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার সচেতন প্রবাসীরা মনে করেন, সচেতনতামূলক প্রচারণা ও স্বদেশিদের মধ্যে পরোপকারের মানসিকতাই এই ভুলের বৃত্ত থেকে বের করে আনতে পারে বাংলাদেশিদের।

এদিকে ছোট ছোট ভুলের জন্য তাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হলেও সেসব ভুল শোধরানোর কোনো পদক্ষেপই নেয়া হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টদের দোষারোপ করেছেন রেমিট্যান্সযোদ্ধারা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসী কর্মীদের ভুল শোধরানোতে বিভিন্ন সময়ে ওপেন হাউজের মাধ্যমে সচেতনতা করা হচ্ছে।

অবৈধ অভিবাসী মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে মাঠে কাজ করছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ। গেলো বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় প্রশাসন বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, দেশটিতে বসবাসরত অবৈধ অভিবাসীদের আটক করার জন্য আরও কার্যকরী ভূমিকায় যাবে সে দেশের প্রশাসন। এ ছাড়া অবৈধকর্মী নিয়োগ দিয়েছে- এমন নিয়োগদাতাকেও আটক করা হচ্ছে।

মালয়া ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক খালেদ শুকরান বলছেন, ‘এই প্রতারণার দায়ভার কেবল দালালদের কাঁধে দেয়ার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রকেও এর দায় নিতে হবে। কোথায় কীভাবে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে তা খুঁজে সমাধান করতে হবে সরকারেই। বিদেশে যেতে ব্যর্থ শতকরা ১৯ ভাগকে শূন্যতে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ, বিলেতফেরত বাংলাদেশিদের সংখ্যাও এখন অনেক বড়।’

বিদেশ থেকে ফেরার পর তাদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যাংক ঋণসহ অন্যান্য সহযোগিতা দেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন এ গবেষক। এ জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা বাড়ানো এবং মধ্যস্থতাকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

তেনাগা ইন্টা: ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার প্রফেসর নওশাদ আমিন বলেন, বিপুলসংখ্যক অভিবাসন-প্রত্যাশীকে পরিকল্পনামাফিক কাজে না লাগালে তারা দেশের বোঝা হয়ে যাবেন। তার ভাষ্য, ‘অভিবাসন প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটানো প্রয়োজন। এ জন্য এ বিষয়ের উপর বিভিন্ন সময় হওয়া গবেষণার তথ্য কাজে লাগাতে হবে। যারা স্টুডেন্ট বা ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে থেকে যাওয়ায় অবৈধ হয়ে পড়েন, এটিও একটি প্রতারণা। এ ধরনের প্রতারণা রাতারাতি কমানো যাবে না।

রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি দালাল ও এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ‘যদিও উল্লেখযোগ্যহারে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে আগ্রহী কর্মীরা চাকরি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন, মানসম্মত জনশক্তির কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা আমরা কতটুকু করতে পেরেছি তা বিবেচনা করা দরকার।’

‘সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৬ থেকে এ পর্যন্ত মোট বিদেশগামী কর্মীর প্রায় অর্ধেকই ছিলেন অদক্ষ। ফলে কর্মসংস্থানের বিপরীতে কাঙ্ক্ষিত রেমিটেন্স আনতে আমরা পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। যদি আরও বেশি দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করা যায় তাহলে রেমিটেন্সের হার অনেক বাড়বে’, বলছিলেন প্রফেসর নওশাদ আমিন।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ



রে