ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

প্রার্থীতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে বিএনপি-আ.লীগের দেড় ডজনের বেশি নেতা

রাজনীতি ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০১৮ নভেম্বর ২৮ ১০:২৫:২৪
প্রার্থীতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে বিএনপি-আ.লীগের দেড় ডজনের বেশি নেতা

হাইকোর্টের আদেশ ও অ্যাটর্নি জেনারেলের ব্যাখ্যার কারণে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রায় দুই ডজনেরও বেশি নেতার নির্বাচনে প্রার্থীতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

যাদের প্রার্থীতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে তারা হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, নাজমুল হুদা, এম মোরশেদ খান ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর নাসিরউদ্দিন ও তার ছেলে ব্যারিস্টার মীর হেলালউদ্দিন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, আমান উল্লাহ আমান ও তার স্ত্রী সাবেরা আমান, সাবেক সাংসদ (ঝিনাইদহ) মশিউর রহমান, ওয়াদুদ ভুঁইয়া (খাগড়াছড়ি), আব্দুল ওহাব (ঝিনাইদহ), হাজি মকবুল আহমেদ, শাহজাহান চৌধুরী (জামায়াতে ইসলামী), হাজি মোহাম্মদ সেলিম, জয়নাল হাজারী ও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।

এদের মধ্যে খালেদা জিয়া, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও তারেক রহমানের সাজা বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। অন্যদের মধ্যে মায়া, এম মোরশেদ খান ও ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এ দুই নেতাকে নিম্ন আদালতের দেয়া সাজাকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এদের মধ্যে মোরশেদ খান ও শাহজাহান ওমরের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে দুদক। এ আপিল এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন।

এ ছাড়া অন্যদের আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন। হাইকোর্টে যাদের আপিল বিচারাধীন তাদের মধ্যে মীর নাসিরউদ্দিন ও তার ছেলে ব্যারিস্টার মীর হেলালউদ্দিন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, আমান উল্লাহ আমান ও তার স্ত্রী সাবেরা আমান, মশিউর রহমান, ওয়াদুদ ভুঁইয়া, আব্দুল ওহাব, হাজি মকবুল আহমেদ, হাজি মোহাম্মদ সেলিম, জয়নাল হাজারী ও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের সাজা এর আগে হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু এ রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপিল বিভাগে আবেদন করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেন। একইসঙ্গে হাইকোর্টকে পুনরায় শুনানি করে রায় দিতে বলা হয়। এরপর থেকে সংশ্লিষ্টদের আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন।

এ ছাড়াও ঋণখেলাপির দায়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হারান চাঁদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ড. শামসুল হক ভূঁইয়া।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, দুর্নীতির দায়ে ২ বছর বা তার বেশি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা যদি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সাজা খেটে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর পরবর্তী ৫ বছর নির্বাচনে অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হন। এ বিষয় বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন ২ বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর ৫ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’

কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এই অনুচ্ছেদের বিধানের বিষয়ে তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, সংবিধানের বিধান কোনো আদালত অগ্রাহ্য করতে পারেন না। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে কেউ খালাস পেলেও সংবিধান অনুযায়ী ৫ বছরের আগে নির্বাচন করতে পারবেন না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষদিন আজ বুধবার। মনোনয়নপত্র বৈধ না অবৈধ, তা জানা যাবে আগামী ২ ডিসেম্বর। এরপর নির্বাচন কমিশন ও উচ্চ আদালতে মনোনয়নপত্র বৈধতা নিয়ে আপিল করা যাবে।

তবে সে জন্য আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার দণ্ড ও সাজা স্থগিত বা বাতিল এবং তাকে জামিন পেতে হবে।

হাইকোর্টে আপিল করা বিএনপির পাঁচ নেতা হলেন আমানউল্লাহ আমান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মো. মশিউর রহমান ও মো. আবদুল ওহাব। এই পাঁচ নেতার নির্বাচনে অংশ নেয়াও এখন অনেকটাই অনিশ্চিত।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও তার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্যই খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় দণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দণ্ড স্থগিত না হলে সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার প্রার্থী হওয়া-না হওয়ার বিষয়টি আদালতের ওপর নির্ভরশীল। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ কয়েকজন আইনজ্ঞও বলছেন, দণ্ডিত হওয়ায় খালেদা জিয়া এবারের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক খালেদা জিয়ার আইনজীবী কায়সার কামাল বলেছেন, নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা এসব রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দিয়েছেন। এখানে কোনো রাজনীতি নেই।

নিম্ন আদালতের দণ্ড ও ভোটে অংশ নেয়া নিয়ে বিতর্ক

সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী নৈতিক স্খলনের জন্য দুই বছরের বেশি সাজা হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে উচ্চ আদালতের এ বিষয়ে দুটি রায় আছে। একটি রায় বলছে, আপিল করার পর সাজা স্থগিত হলে নির্বাচন করতে পারবেন। আরেকটি বিভক্ত রায়ে এক বিচারপতি বলেছেন, নির্বাচন করতে পারবেন; আরেকজন বলেছেন, পারবেন না।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মওদুদ আহমেদ বলছেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। কারণ, নিম্ন আদালতের দণ্ডই চূড়ান্ত দণ্ড নয়। নিম্ন আদালতের দেয়া দণ্ডের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে আপিল করবেন। আবার হাইকোর্টের দেয়া দণ্ড বাতিল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করবেন খালেদা। মওদুদ আহমেদ মনে করেন, খালেদার আপিল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি না হওয়ায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তিনি বলেন, বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পরও আপিল করে সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকার নজির আছে।

সংবিধান, বিভিন্ন রায় ও আইন কী বলে

বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৬ (২) (গ) অনুচ্ছেদ বলছে, কেউ নৈতিক স্খলনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম দুই বছর কারাবাসে থেকে মুক্তির পর পাঁচ বছর পার না হলে তিনি নির্বাচনে যোগ্য হবেন না।

১৯৯৩ সালে জনতা টাওয়ার দুর্নীতির মামলায় বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়ার সাত বছরের মাথায় সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মাদ এরশাদ সংসদ সদস্য পদ হারান। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করলে ২০০১ সালের ২১ মে বিচারপতি জয়নাল আবেদীন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সংবিধানের ৬৬ (২) গ-তে উল্লেখিত কারাদণ্ডের ব্যাখ্যা দেন। বিচারপতি জয়নুল আবেদীন রায়ে বলেন, আপিল বিভাগের মাধ্যমে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু না বলা পর্যন্ত ‘দণ্ডিত হওয়া’ বোঝাবে । বিচারপতি খায়রুল হক রায়ে বলেন, বিচারিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ামাত্রই তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন।

বিচারপতি মোস্তাফা কামাল এক রায়ে বলেছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে দুটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ছাড়া আর কিছুতেই হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় ।

খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তার প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি আদালতের ওপর নির্ভরশীল। সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ইসির ওপর নির্ভরশীল। ইসির নেয়া সিদ্ধান্তের বৈধতা রিটে পরীক্ষা না করতেও আপিল বিভাগের নির্দেশনা আছে। বৈধতা পরখ করতে চাইলে ভোটের পরে করতে হবে, ভোটের আগে নয়। তফসিলের পরে এগুলো নির্বাচনী বিরোধ হিসেবে বিবেচিত হবে। বিষয়টি দেখবেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। হাইকোর্টের বিচারকদের নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল অনধিক ছয় মাসের মধ্যে রায় ঘোষণা করবেন।

তবে বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পর আপিল করে সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকার নজির আছে। দুর্নীতির মামলায় ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি আদালত ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীকে ১৩ বছর কারাদণ্ড দেন। আর সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর সরকারদলীয় সংসদ আবদুর রহমান বদির তিন বছর কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, দুর্নীতির দুটি মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়া সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কারণ, হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের দণ্ড বাতিল করেননি, সাজা বাড়িয়েছেন। তিনি বলেন, দণ্ড বাতিল বা স্থগিত না হলে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকে না।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, দণ্ডিত হওয়ায় সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ



রে