ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১

ফাঁদে ফেসবুক, নাকি ব্যবহারকারী

২০১৮ নভেম্বর ২২ ১১:৪৮:৩৬
ফাঁদে ফেসবুক, নাকি ব্যবহারকারী

এ কারণে সহজে তথ্য ডাউনলোড করতে পারছেন না ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। এটি কিসের ইঙ্গিত? প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট রিকোডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই সপ্তাহ ধরে ফেসবুক থেকে তথ্য ডাউনলোড করে নেওয়ার হার বেড়ে গেছে।

২০১০ সাল থেকে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য ডাউনলোড করে নেওয়ার সুবিধা দিতে শুরু করে। এতে ব্যবহারকারী ফেসবুকে থাকা তাঁর তথ্য, পোস্টের সংগ্রহ, ছবি, অবস্থানগত তথ্য প্রভৃতি ডাউনলোড করে নিতে পারেন। কিন্তু এ বছরের শুরুর দিকে ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা’ কেলেঙ্কারি ফেসবুকের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে। ওই সময় মানুষ বুঝতে পারে, ফেসবুকে তথ্য ডাউনলোড করার একটি সুবিধা আছে। তখন থেকেই ফেসবুক থেকে তথ্য ডাউনলোড করে নেওয়ার হার বেড়ে যায়।

কিন্তু গত অক্টোবর মাস থেকে ডাউনলোডের হার আরও বেড়ে গেছে। অনুরোধ এতটাই বেড়েছে যে ফেসবুককে চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ডাউনলোড করার সুবিধাটি পাচ্ছেন না ব্যবহারকারীরা। তথ্য ডাউনলোড করতে দেরি হচ্ছে। বিষয়টি স্বীকার করেছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।

ফেসবুকের একজন মুখপাত্র বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে ‘ডাউনলোড ইওর ইনফরমেশন’ অনুরোধ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

ফেসবুকের কর্মকর্তা বলেন, ‘কয়েকজন বলেছেন তাঁদের অনুরোধে সাড়া দিতে সময় বেশি লাগছে। এর অর্থ হচ্ছে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে সময় বেশি লাগছে। আমরা এটি ঠিক করতে কাজ করছি এবং ধৈর্য ধরার জন্য প্রশংসা করছি।’

সবাই যে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলার জন্য তথ্য ডাউনলোড করে নিচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। অনেকেই তথ্য নিজের কাছে সংরক্ষণ করে রাখতে ফেসবুক থেকে ডাউনলোড করে রাখছেন। তবে কতজন ফেসবুক মুছে ফেলার জন্য তথ্য ডাউনলোড করে নিচ্ছেন, সে সংখ্যা জানা যায়নি। ফেসবুকের কাছে রিকোড প্রশ্ন করলেও তারা তথ্য দিতে রাজি হয়নি।

ফেসবুক থেকে তথ্য ডাউনলোড করে নেওয়ার হার বাড়ার বিষয়টি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দুশ্চিন্তা বাড়াতে পারে। গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস ফেসবুকের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়টি নিয়ে ফেসবুক যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। এ ছাড়া ফেসবুক ডিফাইনার্স পাবলিক অ্যাফেয়ার্স নামের একটি গণসংযোগ প্রতিষ্ঠান (পিআর ফার্ম) ভাড়া করেছে, যাতে ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমালোচকদের নামে কুৎসা ছড়ানো হয়।

ফেসবুকের সমালোচকদের বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপ ঘিরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিনিয়োগকারীরা জাকারবার্গের ওপর চাপ বাড়াতে থাকেন। তাঁকে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী পদ থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান ফেসবুকের বড় একটি অংশের শেয়ারের মালিক ট্রিলিয়াম অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জোনাস ক্রোন।

নিউইয়র্ক টাইমসের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন রিপাবলিকান রাজনীতিকের মালিকানাধীন রাজনৈতিক পরামর্শক ও পিআর প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া করেছে ফেসবুক। ওই প্রতিষ্ঠানকে ফেসবুক তাদের সমালোচকদের দুর্নাম করার দায়িত্ব দিয়েছে। ওই সংবাদ প্রকাশের পরই জাকারবার্গকে ফেসবুকের চেয়ারম্যান পদটি ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া ফেসবুকের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গের ওপরেও চাপ বাড়াচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের পর গত সপ্তাহজুড়েই ফেসবুকের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথাবার্তা চলছে। সমালোচকেরা ধুইয়ে দিচ্ছেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গকে। নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, ভুয়া খবর ঠেকানোর বিরুদ্ধে অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা, তথ্য ফাঁস কেলেঙ্কারির মতো নানা বিষয়ে সমালোচনা চলছেই।

এরই মধ্যে সিএনএনের লরি সেগালকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মার্ক জাকারবার্গ বলেছেন, তিনি ও তাঁর ডান হাত বলে পরিচিত শেরিল স্যান্ডবার্গের ফেসবুকে থাকা জরুরি। তিনি ফেসবুকের চেয়ারম্যান পদটি ছাড়বেন না। এমনকি শেরিলও তাঁর জায়গা থেকে নড়বেন না। তাঁরা ফেসবুকে রদবদল করতে কাজ করছেন।

জাকারবার্গ এর আগেও বলেছিলেন, ফেসবুক মানুষের আস্থা ফেরাতে কাজ করছে। কিন্তু কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির পর ফেসবুকের ওপর থেকে মানুষের আস্থা কমে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও জাকারবার্গ সে কথা মানতে নারাজ।

কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহযোগিতার জন্য বেশি পরিচিত। ট্রাম্পের বিজয়ে এর ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করছে, ফেসবুক থেকে সংগৃহীত কোনো তথ্য ট্রাম্পের প্রচারণার তারা ব্যবহার করেনি।

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য বেহাত হওয়ার ঘটনাটি সামনে নিয়ে আসেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সাবেক কর্মী ক্রিস্টোফার উইলি। তিনিই প্রথম জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবং যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদ) প্রশ্নে গণভোটে ভূমিকা ছিল তাঁর সাবেক কর্মস্থলের। এ ব্যাপারে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে সহযোগিতা করেছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আলেকসান্দ্র কোগান। তিনি বিশেষ অ্যাপ তৈরি করে ফেসবুকের প্ল্যাটফর্মে ছেড়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে দিয়েছিলেন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে।

ক্রিস্টোফার উইলির ভাষ্যমতে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ওই তথ্যগুলো প্রক্রিয়াজাত করে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার শিবিরকে সরবরাহ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, ওই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য রিপাবলিকান ভোটারও চিহ্নিত করা হয়।

প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, সম্ভবত পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। তবে পরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে, ৮ কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারীর তথ্য বেহাত হয়েছে।

পরে বিষয়টি নিয়ে মার্কিন সিনেটের শুনানিতে হাজির হতে হয় ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গকে। ওই শুনানিতে কয়েকবার মাফ চাওয়ার পাশাপাশি প্রাইভেসি পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতিও দেন জাকারবার্গ।

শুনানিতে জাকারবার্গ বলেন, ‘আমি ফেসবুক শুরু করেছিলাম এবং এর সবকিছুর জন্য আমি দায়ী।’

ফেসবুকের এই কেলেঙ্কারিতে সরব হন সরকার ও রাজনীতির বাঘা বাঘা ব্যক্তি। বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এ ঘটনাকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করেন। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার লন্ডন কার্যালয়ে তল্লাশি চালানোর অনুমতি দেয় দেশটির তথ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ।

বিশ্বজুড়ে ফেসবুক ও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ঘিরে তদন্তের দাবি ওঠে। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরপরই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তাদের নির্বাহী আলেকজান্ডার নিক্সকে বরখাস্ত করে। রাজনীতিবিদদের ফাঁসাতে ঘুষ দেওয়া, যৌনকর্মী ব্যবহারসহ কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার গোপন কৌশল ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন তিনি। পরে সে তথ্য জনসমক্ষে চলে আসে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার পক্ষ থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।

এ ঘটনার জের ধরে গত মে মাসে বন্ধ হয়ে যায় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। গত মার্চ মাসে ‘ফেসবুক কেলেঙ্কারির’ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই চাপে পড়েছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বজুড়ে কঠোর সমালোচনা ছাড়াও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে কয়েকটি দেশ।

শুধু কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নয়, এরপর ফেসবুকের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে তথ্য বেহাত হওয়ার আরেকটি ঘটনা। ফেসবুকের নেটওয়ার্কে হামলা চালিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য হাতিয়ে নেয় সাইবার দুর্বৃত্তরা।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভুয়া খবর, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিয়ে আস্থার সংকটে ভুগছেন ব্যবহারকারীরা। তাই অনেকেই ফেসবুকের তথ্য সরিয়ে নিচ্ছেন। এ ছাড়া রিকোডের প্রতিবেদনে বলা হয়, বছর শেষে অনেকেই ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। নতুন বছরে অন্য কোনো পরিকল্পনা করেন তাঁরা। তাই এখন ফেসবুক থেকে ব্যক্তিগত তথ্য ডাউনলোড করে রাখছেন।

কিন্তু ফেসবুকের জন্য যা শঙ্কাজনক, তা কি সহজে মেনে নেবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। এর আগে খুব সহজে স্বল্প সময়ে আর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ‘ডিলিট’ বা ‘ডিঅ্যাক্টিভেট’ করার সুবিধা বাতিল করেছে তারা। ফেসবুকের মূল প্রোফাইল পুরোপুরি মুছে ফেলার সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণত ফেসবুক থেকে প্রোফাইল মুছে ফেলতে ১৪ দিন বা দুই সপ্তাহ সময় নির্ধারিত ছিল। কেউ যদি অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলার পর আবার ফেরত আসতে চান, তবে ওই সময়ের মধ্যে ফিরে এলে অ্যাকাউন্ট ফিরে পেতে পারেন। ফেসবুক ওই সময় বাড়িয়ে ৩০ দিন বা এক মাস করে দিয়েছে।

এখন যাঁরা ফেসবুক থেকে তথ্য সরিয়ে ফেলতে চান, তাঁদের কিছুক্ষণ দেরি করাবে ফেসবুক। ফেসবুকের এ আচরণ মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী?

সুত্রঃ প্রথম আলো

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



রে