ঢাকা, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

সৌদি প্রবাসীরা সাবাধান, গনহারে গ্রেফতার চালাচ্ছে সৌদি পুলিশ

বিশ্ব ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০১৮ অক্টোবর ০৬ ১২:৪০:৪৫
সৌদি প্রবাসীরা সাবাধান, গনহারে গ্রেফতার চালাচ্ছে সৌদি পুলিশ

প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত দুই সপ্তাহে সৌদি থেকে অন্তত চারশ পুরুষ শ্রমিক দেশে ফিরেছেন।

কিন্তু বেসরকারি তথ্য বলছে, এ সংখ্যা আরও বেশি। কারণ যাদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাদের অনেকের ভিসা নেই। ফলে বিমানবন্দর থেকে তাদের বের হতে শুধু আউট পাস দিয়ে দেশে পাঠানো হচ্ছে।

সৌদি-ফেরত শ্রমিকদের অভিযোগ, দেশটিতে তাদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। সম্প্রতি যারা গেছেন নির্বিঘ্নে কাজ করছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ধরপাকড়। কোনো ধরনের যাচাই করা হচ্ছে না। ঢালাওভাবে বাংলাদেশিদের আটক করে দেশে পাঠানো হচ্ছে।

শ্রমিকরা অভিযোগ করছেন, তাদের প্রত্যেকের কাজের অনুমতিপত্র (আকামা) থাকা সত্ত্বেও আটক করা হচ্ছে। দেশটির সফর জেলে আটক থাকা এবং দেশে ফেরত আসাদের সবার আকামার মেয়াদ রয়েছে। কিন্তু সৌদি পুলিশ তাদের কোনো কথা শুনছে না। দিনে-রাতে রাস্তা-ঘাট, বাসা-বাড়ি ও দোকানপাট থেকে যাদেরই পাচ্ছে, তাদের আটক করছে দেশটির পুলিশ। পরে তাদের নেওয়া হচ্ছে সফর জেলে। সেখানে কিছুদিন রাখার পর দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

সর্বশেষ ৩ অক্টোবর, বুধবার বেলা ৩টায় ৫৫ সৌদি এয়ারলাইন্সের এসভি-৮০৬ বিমানে শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন ১৪৪ জন শ্রমিক।

সৌদি ফেরত শ্রমিক শাকিল আহমেদ জানান, তারা কাগজে-কলমে ১৪৪ জন ফিরেছেন। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আড়াইশ’রও বেশি।

বিমানবন্দরে দায়িত্বরত জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান আনসারী প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সৌদি আরব থেকে ১৪৪ জন পুরুষ শ্রমিক ফিরেছেন। তারা অভিযোগ করছেন, তাদের ধরে ধরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছি জেলা জনশক্তি অফিসের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিতে।’

সৌদি আরব থেকে ফেরত আসিফ ইকবাল প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সৌদি সরকার যাকে পাচ্ছে ধরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও জেলে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আজকে ফ্লাইটে অন্তত ৩০০ জন দেশে ফিরে আসছে। আগামীকালকে আরও শ্রমিক ফেরত আসবে।’

বাংলাদেশে ফেরত আসা শ্রমিক আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি সৌদি আরবে সাড়ে ৬ বছর ধরে ছিলেন। কিন্তু গত মাসের ১৯ সেপ্টেম্বর তাকে সৌদি পুলিশ সড়ক থেকে আটক করে। দেশটির সফর জেলে ১৪ দিন কাটানোর পর বুধবার দেশে পাঠানো হয়েছে।

আনোয়ারের অভিযোগ, তার আকামা আছে। সেটির মেয়াদও আছে। কিন্তু তাকে ধরে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। দেশে ফিরে তিনি এখন কী করবেন, চোখে অন্ধকার দেখছেন।

সৌদি-ফেরত শ্রমিক আতিকুর রহমান জানান, দেশটিতে প্রতিদিনই ৫০ থেকে ১০০ জন করে আটক করছে সৌদি পুলিশ। দেশটির সফর জেলে এখনো এক হাজারের মতো পুরুষ আটক আছেন। তাদের আটকের পর বিভিন্ন মামলা দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তবে জেলে থাকাকালীন তাদেরকে নির্যাতন করা হয়নি।

আতিকুর আরও জানান, সৌদির আল কাসির, দাম্মাম ও রিয়াদসহ বিভিন্ন শহরে গণহারে বাংলাদেশিদের আটক করা হচ্ছে। পুলিশ গাড়িতে তোলার পর থানায় নিয়ে সবজি বিক্রি, ফলমূল ও পানি বিক্রিসহ অবৈধভাবে চলাফেরার মিথ্যা মামলা টুকে দিয়ে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে।

আতিক ঋণ করে সাড়ে ছয় লাখ টাকা খরচ করে সৌদি গেলেও মাত্র আড়াই লাখ টাকা এ পর্যন্ত তুলতে পেরেছেন। বাকি টাকা কী করে তুলবেন, আর বাড়িতে করা ঋণ শোধ করবেন তা তিনি জানেন না।

শাওন নামের এক শ্রমিকের অভিযোগ, তাদের আটকের খবর বাংলাদেশি দূতাবাসে পৌঁছালেও তারা কিছুই করছেন না। এ ব্যাপারে তারা দূতাবাসের কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। উল্টো হয়রানি হচ্ছেন।

শাওন জানান, দেশটির আকামার দামও বেড়ে গেছে। আগে আকামা তৈরি করতে ২০০ রিয়াল লাগত। এখন লাগে ৮০০ রিয়াল। অন্যদিকে মক্তবে আমেল (সরকারি ফি) ১২০০ রিয়াল থেকে বেড়ে ৪ হাজার ৮০০ রিয়ালে দাঁড়িয়েছে।

আতিক, শাওন ও আনোয়ারের মতোই একইভাবে দেশে ফিরে এসেছেন চট্টগ্রামের মফিজুল ইসলাম বাবলু। তিনিও বলছেন, আকামার মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

সৌদি ফেরত কুষ্টিয়ার মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান জানান, তিনি শুধু বাসা থেকে বের হয় সিগারেট কেনার জন্য দোকানে যাওয়ার পথে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়।

জিয়াউর রহমান আরও জানান, মসজিদ থেকে কিংবা সুপার শপ থেকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশিদের।

ফরিদপুরের আব্দুস সালাম ১৫ বছর সৌদি ছিলেন। কিন্তু সব কিছু ঠিক থাকার পরেও তাকে দেশে ফিরতে হয়েছে। সালাম বলেন,‘ সেই দেশে ফাঁসি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে সবাই গলায় দঁড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতাম। কিন্তু বৌ বাচ্চাদের মুখ চেয়ে পারি নাই।’

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি সরকার ১২টি খাতকে সরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে সে কার্যক্রম। আর দেশটির নাগরিকদের বেকারত্ব দূর করতেই ১২ সেক্টর ছাড়া কেউ কাজ করতে পারবে না বলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা তথ্যমতে, সৌদি নাগরিকদের বেকারত্ব দূর করতে ১২টি সেক্টরে সে দেশের নাগরিক ছাড়া আর কেউ কাজ করতে পারবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেক্টরগুলো হলো–মোটরযান/মোটর সাইকেল কিংবা এর যন্ত্রাংশ খুচরা বা পাইকারি বিক্রয় কেন্দ্র, পাইকারি ও খুচরা কাপড়, জুতা, ফার্নিচার, প্রসাধনী, গৃহের পণ্য, তৈজসপত্র বিক্রয় কেন্দ্রসহ ১২ সেক্টর।

এ ঘোষণার পর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের আটক করে দেশে পাঠানো হচ্ছে। তবে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফিরছেন। গত দেড় বছরে ৭ লাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিক সৌদি আরব ছেড়েছে।

সৌদি সরকারের পরিসংখ্যান দফতরের দেওয়া তথ্যমতে, গত তিন মাসে ২ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ জন দেশ ত্যাগ করেছেন।

প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের হেড অব প্রোগ্রাম শরিফুল হাসান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সৌদি সরকার যাদের ফেরত পাঠাচ্ছে তাদের হয়তো ভিসা বা আকামা নেই। আবার অনেকে ফ্রি ভিসায়ও গিয়ে থাকে। সৌদি থেকে তাদের কেন ও কী কারণে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, সে বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের খতিয়ে দেখা দরকার। পাশাপাশি যারা এখন দেশটির সফর জেলে আছেন, তারা যেন আইনি সহায়তা পান সে বিষয়টি সরকারের নজর দেওয়া দরকার।’

সৌদি সরকারের ১২ খাতকে সরকারিকরণের সিদ্ধান্তের প্রভাব কিছুটা হলেও পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করেন অভিবাসন নিয়ে কাজ করা এ সমাজকর্মী।

এ বিষয়ে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ( বিএমইটি) মহাপরিচালক সেলিম রেজাকে কয়েক দফা ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ



রে