ঢাকা, শনিবার, ১ মার্চ ২০২৫, ১৭ ফাল্গুন ১৪৩১

রাশিয়া বিশ্বকাপের শ্বাসরুদ্ধকর পাঁচটি ম্যাচ

খেলা ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০১৮ জুলাই ১৫ ১৯:৩৪:২০
রাশিয়া বিশ্বকাপের শ্বাসরুদ্ধকর পাঁচটি ম্যাচ

ফাইনাল ম্যাচের আগে শেষ হয়েছে ৬৩টি ম্যাচ। এই ৬৩ ম্যাচে ফুটবল বিশ্ব থমকে গিয়েছে নানান অঘটনে, সাক্ষী হয়েছে ধ্রুপদী কিছু লড়াইয়ের। বিশেষজ্ঞদের মতো এবারের বিশ্বকাপের মতো উত্তেজনাপূর্ণ আসর আর আগে দেখেনি বিশ্ব। অনেকে আবার রাশিয়া বিশ্বকাপকে আখ্যায়িত করেছেন ‘জায়ান্ট কিলার’ বিশ্বকাপ হিসেবে।

কেননা এবারের বিশ্বকাপে মোটামুটি দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে গিয়েছিল অনেক বড় দল। কোয়ার্টার ফাইনালের পর আর বাকি ছিল না কেউই। দুর্দান্ত খেলার মাধ্যমে তুলনামূলক কম শক্তির দলরা চমকে দিয়েছে বড় দলগুলোকে। লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ফাইনালের আগে দেখে নেয়া সেসব ম্যাচের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ম্যাচের ঘটনা :

স্পেন বনাম পর্তুগাল (গ্রুপ পর্ব)

1

বিশ্বকাপের দ্বিতীয় দিনেই মুখোমুখি হয়েছিল দুই ফেবারিট দল স্পেন ও পর্তুগাল। গ্রুপ পর্বের অন্যতম সেরা ম্যাচ হবে তা আগে থেকেই অনুমান করা হচ্ছিল। ম্যাচের দিন মাঠে হতাশ করেনি এই দুই দল। ম্যাচের ফলাফল ছিল ৩-৩। ফল দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুরো ম্যাচ জুড়েই ছিল আক্রমণের ঝড়। যা শেষে জেতেনি কোন দল।

পর্তুগালের পক্ষে এদিন একাই লড়েন দেশটির সেরা তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। একাই করেন দলের ৩টি গোল, বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিকের পাশেও লেখান নিজের নামটা। ম্যাচে দুইবার পিছিয়ে পড়েও ম্যাচে লিড নিয়ে নেয় স্পেন। কিন্তু ম্যাচ শেষের আগে নিজের হ্যাটট্রিক পূরণের পাশাপাশি স্পেনের জয়ও ঠেকিয়ে দেন রোনালদো।

চতুর্থ মিনিটেই প্রথম গোল পেয়েছিল পর্তুগাল। পেনাল্টি থেকে গোল করে নিজ দলকে এগিয়ে দেন রোনালদো। ২৪তম মিনিটে ম্যাচে সমতা ফেরান স্পেনের ডিয়েগো কস্তা। বিরতিতে যাওয়ার আগে ডিবক্সের বাইরে থেকে গোল করে আবার পর্তুগালকে লিড এনে দেন রোনালদো।

বিরতি থেকে ফিরে পরপর দুই গোল করে উলটো লিড নেয় স্পেন। প্রথম ৫৫তম মিনিটে নিজের দ্বিতীয় গোল করে দলকে আবার সমতায় বসান কস্তা। পরে ৫৮তম মিনিটে গোল করে লিড এনে দেন নাচো। ৩-২ গোলের জয়ের অপেক্ষায় ছিল স্পেন। তখনই ম্যাচের ৮৮তম মিনিটে দুর্দান্ত এক ফ্রিকিকে গোল করে ৩-৩ গোলের সমতায় ম্যাচ শেষ করেন পর্তুগালের রাজা রোনালদো।

রাশিয়া বনাম ক্রোয়েশিয়া (কোয়ার্টার ফাইনাল)

2

এটিও আরেকটি ড্র হওয়া ম্যাচ। যেই ম্যাচের নিষ্পত্তি হয়েছিল টাইব্রেকারে। কারণ ম্যাচটি ছিল শেষ আটের। রাশিয়া বনাম ক্রোয়েশিয়ার এই কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে ১২০ মিনিট শেষে ফলাফল ছিল ২-২। পরে টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জিতে সেমিফাইনালের টিকিট পায় ক্রোয়েশিয়া।

বিশ্বকাপের শুরু থেকেই দুর্দান্ত খেলতে থাকা স্বাগতিক রাশিয়া এই ম্যাচেও চেপে ধরেছিল ক্রোয়েশিয়ানদের। ম্যাচের ৩১ মিনিটেই তারা করে বসে প্রথম গোলটি। অসাধারণ এক গোলে নিজ দলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন ডেনিশ চেরিশেভ। তবে ৩৯তম মিনিটেই তা শোধ করে দেয় ক্রোয়েশিয়া। দলের পক্ষে গোল করেন ক্রামারিচ।

ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে মুহূর্মুহু আক্রমণ করেও গোল করতে ব্যর্থ হয় দুই দল। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১৫ মিনিট করে দুই অর্ধে হওয়া এই খেলার প্রথমার্ধে ক্রোয়েশিয়াকে এগিয়ে দেন ডোমাগজ ভিদা। ম্যাচ যেন তখন ক্রোয়েশিয়ার হাতের মুঠোয়। ঠিক তখন দ্বিতীয় ১৫ মিনিটের শেষের দিকে ম্যাচের সমতাসূচক গোলটি করেন মারিও ফার্নান্দেস। তার এই গোলে বেঁচে থাকে থাকে স্বাগতিকদের আশা। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে।

পেনাল্টি শ্যুটআউটে স্বাগতিকদের স্বপ্ন ভেঙে দেন অতিরিক্ত সময়ে গোল করে রাশিয়ার আশা বাঁচিয়ে রাখা ফার্নান্দেসই। রাশিয়ার গোলরক্ষক ইগোন আকিনফিভ ও ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক ড্যানিয়েল সুবাসিচ উভয়েই ১টি করে শট ঠেকিয়ে সমতা রেখেছিলেন টাইব্রেকারেও।

তখনই শট নিতে আসেন ফার্নান্দেস। অতিরিক্ত সময়ের শেষদিকে প্রবল স্নায়ুচাপ জয় করে দলকে সমতায় ফেরানো ফার্নান্দেস নিতে পারেননি টাইব্রেকারের চাপ। ডিবক্সের বাইরে মেরে দেন নিজের শট। ফলে এগিয়ে যায় ক্রোয়েশিয়া। তাদের শেষ শট নিতে আসেন ইভান রাকিটিচ। খুব সহজেই গোল করে দলকে সেমিফাইনালে নিয়ে যান রাকিটিচ।

ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনা (দ্বিতীয় রাউন্ড)

3

গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনা হোঁচট না খেলে ফাইনালের আগে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাই ছিলো না ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনার। কিন্তু আর্জেন্টিনার হতাশামূলক পারফরম্যান্সে দ্বিতীয় রাউন্ডেই ফুটবল বিশ্ব সাক্ষী হয় অসাধারণ এক ম্যাচের। দুই দলেই সব তারকা ফরোয়ার্ডরা থাকায় গোলের বন্যা হবে তা অনুমান করা যাচ্ছিল আগেই।

কাজান এরেনায় রীতিমতো গোলের বন্যাই বসিয়েছিলেন কাইলিয়ান এমবাপে-লিওনেল মেসিরা। দুই দল মিলে ৭ গোল করেছিল সেদিন। লিওনেল মেসিকে আড়াল করে ম্যাচের পুরো আলো কেড়ে নিয়েছিলেন ১৯ বছর বয়সী এমবাপে। তার জোড়া গোলে ৪-৩ ব্যবধানে ম্যাচ জিতে ফ্রান্স। আর্জেন্টিনাকে বিদায় করে দিয়ে তারা পেয়ে যায় শেষ আটের টিকিট।

ম্যাচের প্রথম গোলটা করেন আন্তোনিও গ্রিজম্যান। এই গোলের পেনাল্টি আদায়েও ছিলেন এমবাপে। আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডার মার্কস রোহো তাকে ডিবক্সের মধ্যে ফাউল করলে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। সেখান থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে নেন গ্রিজম্যান। অবশ্য বেশিক্ষণ লিড ধরে রাখতে পারেনি ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ীরা।

দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর ৪ মিনিট আগে প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে চলতি বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা গোলটি করে আর্জেন্টিনাকে ম্যাচে ফেরান অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। পরে বিরতি থেকে ফিরে দলকে এগিয়ে দেন আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগের খেলোয়াড় মার্কাদো। এরপরই বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা খেলা দেখতে পায় ফুটবল বিশ্ব।

২-১ গোলে পিছিয়ে থাকা ফ্রান্স টানা ৩ গোল করে আক্ষরিক অর্থেই ম্যাচ থেকে ছিটকে দেন মেসিদের। ৫৭তম মিনিটে ডিবক্সের বাইরে ডি মারিয়ার গোলের মতো করেই অসাধারণ এক গোল করে সমতা ফেরান পাভার্দ। পরে টানা দুই গোল করে দলের জয় প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেন এমবাপে। শেষদিকে সার্জিও আগুয়েরো এক গোল শোধ করলেও বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের বিদায় ঠেকাতে পারেননি।

জার্মানি বনাম সুইডেন (গ্রুপ পর্ব)

4

বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর কাছে হেরে যায় জার্মানি। ফলে বিশ্বকাপে টিকে থাকতে দ্বিতীয় ম্যাচে জিততেই হবে। এমন সমীকরণ নিয়েই সুইডেনের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিল ২০১৪ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। এই ম্যাচের একাদশে বড়সড় চমক দেন জোয়াকিম লো। প্রথমবারের মতো কোণ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে মেসুত ওজিলকে ছাড়াই একাদশ সাজান জার্মান কোচ।

ম্যাচ জিতলেই বিদায় ঘণ্টা বেজে যাবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের, এই সুযোগটা নিতে উন্মুখ হয়েছিল সুইডেন। ম্যাচের শুরু থেকেই জার্মান রক্ষণে হানা দিতে থাকা তারা। ৩১তম মিনিটে ওলা তোইভোনেনের গোলে লিডও পেয়ে যায় তারা। গোল হজম করে দমে যেতে রাজি ছিল না জার্মানি। অন্যদিকে লিড ধরে রাখতে মরিয়া ছিল সুইডেন।

তবে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই জার্মানিকে সমতায় ফেরান বদলি হিসেবে খেলতে নামা মার্কো রয়েস। ড্র হলেও খুব একটা লাভ হত না জার্মানির। অন্যদিকে ন্যুনতম ১ পয়েন্ট পেলেও চলতো সুইডেনের। তাই নিজেদের রক্ষণ সামলানোর দিকেই নজর দিতে শুরু করে সুইডিশরা। একের পর এক আক্রমণ করেও গোল পেতে ব্যর্থ হয় জার্মানরা।

ম্যাচের সময় যতো গড়াচ্ছিল ততোই ফিকে হচ্ছিল জার্মানির জয়ের আশা। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায় নির্ধারিত ৯০ মিনিট। ইনজুরি সময় হিসেবে যোগ করা হয় ৬ মিনিট। সেটিও ছিলো একদম শেষের দিকে। ঠিক তখনই ৯৫তম মিনিটে ডিবক্সের ঠিক বাইরে ফ্রিকিক পায় জার্মানি। সেখান থেকে অসামান্য নৈপুণ্যে সরাসরি গোল করে জার্মানিকে জয় পাইয়ে দেন টনি ক্রুস। একইসাথে বাঁচিয়ে রাখেন নিজ দেশের বিশ্বকাপ যাত্রাও।

বেলজিয়াম বনাম জাপান (দ্বিতীয় রাউন্ড)

5

প্রথম পর্বে দুর্দান্ত ফুটবল খেলে দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট পেয়েছিল জাপান। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন কলম্বিয়াকে হারালেও, পোল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়ায় গ্রুপ রানারআপ হতে হয় তাদের। ফলে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলতে হয় বেলজিয়ামের বিপক্ষে। সবাই ধরে রেখেছিল সহজেই জিতে বেলজিয়াম।

কিন্তু জাপানের মাথায় ছিল ইতিহাস গড়ার চিন্তা। সব দল যেখানে বড় দলের বিপক্ষে রক্ষণাত্মক ফুটবলের নেতিবাচক পরিকল্পনা সাজায়, সেখানে পুরো ম্যাচে জাপান খেলতে আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে। এই পরিকল্পনার সুফলও পেয়ে যায় তারা। কিন্তু নেহায়েত কপাল দোষেই একদম শেষমুহূর্তের গোলে ৩-২ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় তারা।

ম্যাচের প্রথমার্ধে গোল করতে ব্যর্থ হয় দুই দলই। পাঁচ ম্যাচের সবকটিই হয় ম্যাচের পরবর্তী ৪৫ মিনিটের খেলায়। ম্যাচের ৪৮তম মিনিটে ম্যাচের প্রথম গোলটি করেন জাপানের জেনকি হারাগুচি। মিনিট চারেক পরে অসাধারণ এক কাউন্টার অ্যাটাকে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন তাকাশি ইনুই। দুই গোলের লিড নিয়ে ম্যাচের আধিপত্য তখন জাপানের হাতেই।

কিন্তু এটি মেনে নিতে রাজি ছিল না বেলজিয়াম। একের পর এক আক্রমণ করে তারাও ব্যতিব্যস্ত রাখে জাপানের রক্ষণকে। যার পুরষ্কার পায় ম্যাচের ৬৯তম মিনিটে। প্রথম ভারটোঙ্গেনের হেডে ব্যবধান কমায় তারা, পরে ৭৪তম মিনিটে ফেলাইনির হেডে ম্যাচে সমতা ফেরায় তারা।

২-২ গোলের সমতায় ম্যাচ চলে যায় একদম শেষের দিকে। সবাই অপেক্ষায় ছিল অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের। ঠিক তখনই দুর্দান্ত এক কাউন্টারে জাপানের স্বপ্ন ভেঙে দেন নাসের চাদলি। শেষ বাঁশি বাজার ত্রিশ মিনিট আগে গোল খেয়ে ৩-২ গোলের পরাজয় নিয়ে বিশ্বকাপ থেকে ফেরত যায় এশিয়ান পরাশক্তিরা।

রাশিয়া বিশ্বকাপে এখনো বাকি ফাইনাল ম্যাচটি। সকলের প্রত্যাশা ফাইনাল ম্যাচের উত্তেজনা ছাড়িয়ে যাবে আগের ৬৩টি ম্যাচকেও। তবে ফাইনাল ম্যাচের সবচেয়ে বেশি উত্তেজনাকর ম্যাচের তালিকা করলে উপরের দিকেই থাকবে উপরোল্লিখিত ম্যাচগুলো। তর্কসাপেক্ষে এই বিশ্বকাপের সেরা কয়েকটি ম্যাচও বলা যায় এই পাঁচ ম্যাচকে।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ



রে