ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

রয়্যালিটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিল্পীরা, দায় কার?

বিনোদন ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০১৮ মে ৩০ ২১:০৭:৩০
রয়্যালিটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিল্পীরা, দায় কার?

কোনো ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি বা সম্পদ ব্যবহারের জন্য সম্মানী দেওয়াকে মেধাস্বত্ব বা রয়্যালিটি বলা হয়। রয়্যালিটির জন্য দুটি পক্ষের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তি অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত শতকরা হিসাবে রয়্যালিটির ভাগ দেওয়া হয়ে থাকে। আগে গানের প্রচারমাধ্যম শুধু রেডিও ও টেলিভিশন হলেও; বর্তমানে এর ব্যাপ্তি ঘটেছে এফএম রেডিও, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, মোবাইল অপারেটর, ইন্টারনেট এবং ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে। এদের মধ্যে সিংহ ভাগই ফাঁকি দিচ্ছে শিল্পীদের। নতুন প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পীরা এ বিষয়ে সচেতন থাকার চেষ্টা করলেও অধিকাংশ প্রবীণ খ্যাতিমান শিল্পীই এ বিষয়টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন অজপাড়াগাঁ বা মফস্বলে বসবাসরত সুরকার-গীতিকার এবং শিল্পীরা।

আশি-নব্বই দশকে বাংলাদেশের সংগীতজগৎ ছিল বেশ সমৃদ্ধ। শিল্পীরা এ পেশার মাধ্যমে সচ্ছল এবং স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতেন। কিন্তু গত এক দশকে সংগীতজগতে চলছে নানামুখী অস্থিরতা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে নানা ধরনের গান শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শিল্পী-সুরকার-গীতিকার এবং গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পাচ্ছেন না তাদের ন্যায্য রয়্যালিটি। এর ফলে সংগীতকে একমাত্র পেশা হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন অনেক প্রতিভাবান শিল্পীই, অথচ অন্যদিকে অবৈধভাবে গানের পাইরেসি করে অবৈধ অর্থ উপার্জন করছে একশ্রেণির অসাধু প্রতিষ্ঠান।

রয়্যালিটি ঠিকমতো প্রদান না করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অভিযোগ আছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। এ অভিযোগগুলো নিয়ে কথা হয় প্রযোজনা সংস্থা সঙ্গীতার কর্ণধার সেলিম খানের সঙ্গে। এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘শিল্পীদের সঙ্গে সঙ্গীতার এ ধরনের ঝামেলা হয় না, কারণ আমরা রয়্যালিটি সিস্টেমটাই এপ্লাই করি না। সব গানের কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও গীতিকারের সঙ্গে আমাদের এককালীন একটা চুক্তি হয়, সেই মোতাবেক আমরা অর্থ প্রদান করে থাকি।’

একজন শিল্পীর গান সারা জীবন ব্যবহার করার সুযোগ পেলেও কেন তাদের রয়্যালিটি প্রদান করার সিস্টেমের প্রচলন শুরু করছে না সঙ্গীতা, জানতে চাইলে সেলিম খান বলেন, ‘রয়্যালিটির প্রচলন করলে এ ধরনের অভিযোগ থাকবেই। এইসব এড়ানোর জন্যই আমরা এগুলোর ঝামেলায় যাই না। এককালীন চুক্তির মাধ্যমে কেউ আমাদের এখান থেকে গান করতে চাইলে করবেন, না করতে চাইলে করবেন না। এটা তো তাদের পছন্দের বিষয়, আমরা তো আর জোর করছি না।’

তবে শিল্পীদের রয়্যালিটি প্রদানের ক্ষেত্রে বরাবরই ব্যতিক্রম গানচিল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। গানচিল কয়েক মাস পরপরই তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ শিল্পী ও কুশলীদের রয়্যালিটির টাকা নিজেরাই ডেকে দিয়ে থাকেন। সে প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ও গীতিকার আসিফ ইকবাল বলেন, ‘এফএম রেডিও স্টেশনগুলো কন্টেন্টের জন্য একটি পয়সাও কাউকে দেয় না। অথচ বিজ্ঞাপনের জন্য কোটি কোটি টাকা তারা নিচ্ছে। এত এত কনসার্ট হয়, এতগুলো টেলিভিশন হয়েছে, সেখানে এত প্রোগ্রাম হয়, শিল্পীদের শুধু টাকা দেওয়া হচ্ছে, সুরকার-গীতিকার কোনো টাকা পাচ্ছেন না। আমরা গানচিল থেকে গীতিকার-সুরকার-শিল্পী, সবাইকেই সম্মানী দিয়ে থাকি। গত তিন বছরে আমরা প্রায় সত্তর লক্ষ টাকার ওপরে রয়্যালিটি দিয়েছি। আমি চাই, এটা শুধু আমরা না, সবাই-ই এ বিষয়ে এগিয়ে আসুক এবং এটা একটা রেগ্যুলার প্র‍্যাক্টিসে পরিণত হোক, যাতে করে শিল্পীরা বাঁচে, ভালো গান যাতে তৈরি হয় বাংলাদেশে।’

কপিরাইটসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে সারা বিশ্বেই সবসময় একাধিক পক্ষ সংশ্লিষ্ট। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রী ও প্রযোজনা সংস্থা বা উৎপাদকসহ সংশ্লিষ্টরা সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন। পুরো পৃথিবীতে জীবিত শিল্পীরা এবং মৃত্যুর পর তাদের বৈধ উত্তরাধিকারীগণ ৫০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত সৃষ্টিকর্মের রয়্যালটি পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশি আইনে একজন শিল্পীর মৃত্যুর পর ৬০ বছর পর্যন্ত এই অধিকার বলবৎ থাকে। অথচ জীবিত অবস্থাতেই কোনো সম্মানী না পেয়ে, যথাযথ চিকিৎসা না নিতে পেরে চলে গেছেন আযম খান, লাকী আখন্দ, আব্দুল জব্বার খান, শাম্মী আখতারসহ খ্যাতিমান শিল্পীরা।

শিল্পীদের রয়্যালিটি পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর কাছে। প্রিয়.কমকে তিনি জানান, ‘আগে শুধু টেলিভিশন-রেডিও দিয়ে রয়্যালিটি চিন্তা করা হতো। এখন তো সব ইন্টারনেটভিত্তিক। ইন্টারনেটে শিল্পীদের অসংখ্য গান গেলেও এখনো এগুলো কোনো ডিসিপ্লিনের মধ্যে আসেনি। গানের ক্ষেত্রে শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার—এ তিন পক্ষের কে কত টাকার অংশীদার হবেন, এটির একটি আন্তর্জাতিক পার্সেন্টিজ ঠিক করে দেওয়া আছে। আমাদের দেশে এর কোনো সুরাহা অতীতেও হয়নি, এখনো নেই। এই পার্সেন্টিজ পাওয়ার জন্য যে চেষ্টা-চরিত্র করতে হয়, সেসব ঝামেলাতেও আমাদের শিল্পীরা পড়তে চান না। এ মানসিকতা বদলাতে পারছেন না বলেই বঞ্চিত হচ্ছেন।’

শুধু সংগীতশিল্পীরাই নন, মোবাইল অপারেটরদের রয়্যালিটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অন্যান্য অঙ্গনের বিশিষ্টজনরাও। প্রিয়.কমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশের জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ অভিযোগ করেছিলেন, তার জনপ্রিয় কবিতা ‘তোমার চোখ এত লাল কেন’ ওয়েলকাম টিউন হিসেবে ব্যবহার করে গ্রামীণফোন তার ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে মাসে ৩০ টাকা করে কেটে নিচ্ছে, অথচ রয়্যালিটি হিসেবে কবিকে একটি টাকাও এখন পর্যন্ত দেননি তারা। তিনি ওই সাক্ষাৎকারে গ্রামীণফোনের এই কাজের তীব্র নিন্দা জানান।

এদিকে শিল্পীদের গান এবং শিল্পকর্ম ব্যবহার করা সত্ত্বেও মোবাইল অপারেটররা কেন রয়্যালিটি প্রদানে গড়িমসি করে থাকে? শিল্পীদের এসব নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে কথা বলতে যোগাযোগ করা হয় ‘রবি’র জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা তারিক মুর্তাজার সঙ্গে। তিনি জানালেন, আগে রবির গ্রাহকরা সরাসরি তাদের কাছ থেকে গান ব্যবহার করলেও, এখন ইয়োন্ডার মিউজিকের অ্যাপসের মাধ্যমে গান ব্যবহার করে থাকেন। ফলে এখন শিল্পীদের সঙ্গে আর রবির চুক্তি হয় না, সরাসরি ইয়োন্ডার মিউজিকই এই চুক্তি করে থাকে। তবে ইয়োন্ডার মিউজিকে যারা গান দিয়ে থাকেন, চুক্তি অনুযায়ী তাদের সবাইকেই যথাযথ রয়্যালিটি প্রদান করা হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

একই প্রসঙ্গে কথা হয় প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে। প্রিয়.কমকে বর্ষীয়ান এই সংগীতজ্ঞ জানান, ‘রেডিও, টেলিভিশন, অডিও বা ভিডিও যেখানেই গান বাজুক না কেন, এর একটা অংশ শিল্পীরা পাবেই। এ নিয়মই পৃথিবীর সর্বত্র চলে আসছে। এ আইনটা একাত্তর সাল থেকে আশির দশক পর্যন্ত এ দেশে তেমন প্রচলিত ছিল না। আশির পরে সরকার কিছুটা উদ্যোগী হয়েছিল, কিন্তু এটার কার্যকারিতা আমরা এখনো পর্যন্ত দেখছি না। সব শিল্পীর প্রত্যেকটা গান তো আর জনপ্রিয় হয় না, যে কয়টা গান হয়, সেগুলোর রয়্যালিটিও যদি তারা পেতেন, তবে তাদের এই অভাব-অনটন থাকার কথা না। যেকোনো জনপ্রিয় গান কোনো-না-কোনো মাধ্যমে ষোলো কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। যে মাধ্যমে গানগুলো মানুষ শুনতে পারছেন, সে মাধ্যমগুলো গান শুনিয়ে টাকা পাচ্ছে। কিন্তু শিল্পীদের অংশটুকু তারা দিচ্ছে না। এটার একমাত্র কারণ গানগুলো নিজেদের নামে লিপিবদ্ধ করতে যে কপিরাইট করতে হয়, সেটা অধিকাংশ শিল্পীই করছেন না। এ কপিরাইট ছাড়া কেউ হাজারবারও যদি বলে গানগুলো তার, তবুও সেগুলো তার হবে না, যতক্ষণ না সরকারিভাবে তাদের নামে গানগুলো লিপিবদ্ধ হচ্ছে।’

এদিকে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের অর্থনৈতিক ও নৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ লিরিসিস্টস, কম্পোজারস অ্যান্ড পারফরমার্স সোসাইটি (বিএলসিপিএস)-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সংগীতশিল্পী সুজিত মোস্তফার কাছে এ সংস্থাটির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে এবং শিল্পীদের স্বার্থ আদায়ে কী কী পদক্ষেপ তারা নিয়েছেন প্রশ্ন করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, শিগগিরই এ সংস্থার সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের কথা রয়েছে, এরপরই নিজেদের কাজের অগ্রগতির সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারব আমরা।’

এ ছাড়া সংগীতশিল্পীদের জন্য গানের একটি পরিপূর্ণ ডিজিটাল আর্কাইভ নির্মাণের একটি প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছেন সংগীতশিল্পী প্রীতম আহমেদ। এ প্রকল্পে দেশের সব শিল্পীর গানের একটি ডিজিটাল আর্কাইভ নির্মাণ করা হবে, যার মাধ্যমে শিল্পীরা আর্থিক দিক থেকে লাভবান হবেন এবং মেধাস্বত্ব অধিকার সংরক্ষিত হবে। বাংলাদেশ সরকারের উদ্ভাবনী প্রকল্প থেকে মোট ১০ লাখ টাকার একটি অনুমোদনও পেয়েছেন তিনি।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



রে