ঢাকা, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

‘ডুবছে’ ভারতীয় মিডিয়া, দেখাচ্ছে না সংবাদ মাধ্যমগুলো

বিশ্ব ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০১৮ মে ২৯ ১৬:৫৭:০৪
‘ডুবছে’ ভারতীয় মিডিয়া, দেখাচ্ছে না সংবাদ মাধ্যমগুলো

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বলছে, যেকোনো দেশ এমন একটি অভিযোগে তোলপাড় শুরু হয়ে যেত, কিন্তু ভারতে বিভিন্ন কারণে এটি নিয়ে তেমন কথা হচ্ছে না। বিশেষত প্রভাবশালী মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনায় সেগুলোর বেশিরভাগই নিজেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের খবরটি প্রচার করেনি।

নিউজ ওয়েবসাইট কোবরা পোস্টের একটি স্টিং অপারেশন (অপরাধীদের জন্য ফাঁদ পেতে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের অভিযান)-এ দেখা গেছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-এরপক্ষপাতিত্ব করছে ভারতের অনেকগুলো প্রধান মিডিয়া গ্রুপ। এতে আরও দেখা গেছে দেশটির সবচেয়ে প্রবীণ কয়েকজন মিডিয়া কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক টাকা নিয়ে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য প্রচারণা চলাতে আগ্রহী।

কোবরা পোস্ট একটি ছোট কিন্তু আলোচিত বিতর্কিত নিউজ সাইট। গোপনে স্টিং অপারেশন চালানোর জন্য সুপরিচিত সাইটটি নিজেদেরকে অলাভজনক সংবাদ মাধ্যম বলে পরিচিতি দিয়ে থাকে। সাইটটি মনে করে ভারতে সাংবাদিকতাকে ‘খেলো’ করে ফেলা হয়েছে।

তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটির নাম তারা দিয়েছেন ‘অপারেশন ১৩৬’। উল্লেখ্য, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ২০১৭ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ১৩৬।

ওয়েবসাইটটি জানায়, তাদের সংগ্রহ করা রেকর্ডিংগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো টাকা খেয়ে ‘‘শুধু দেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধই সৃষ্টি করতে চাইছে না, তারা নির্বাচনের ফলাফল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পক্ষে নিয়ে যেতে কাজ করছে।’

যদিও, এই ধরনের চোরাগোপ্তা স্টিং অপারেশন কখনও কখনও অনির্ভরযোগ্য। ভিডিও ফুটেজগুলো খুব সহজেই পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যেতে পারে বা এডিট করে কথোপকথনের মানে বদলে দেয়া যেতে পারে অথবা এর মূল উদ্দেশ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হতে পারে।

কোবরা পোস্টের একজন ছদ্মবেশী রিপোর্টার পুস্প শর্মা জানান, তিনি প্রধান মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ২৫ জনেরও বেশি কর্মকর্তার কাছে গিয়ে একইভাবে টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেন।

ছদ্মবেশে গিয়ে তিনি নিজেকে একটি বিত্তশালী হিন্দু আশ্রমের প্রতিনিধি বলে পরিচয় দেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি যেন ক্ষমতায় থাকে তা নিশ্চিত করতে ওই আশ্রমটি আগামী বছর ভারতের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত বিশাল অংকের টাকা খরচ করবে বলে মিডিয়া কর্মকর্তাদের টোপ ফেলেন তিনি।

শর্মা বলেন, তার অর্থ যোগানদাতারা তিন ধাপে অর্থ সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা করেছে।

প্রথমে, তিনি প্রস্তাব করেন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘মৃদু হিন্দুত্ব’-এর সমর্থনে প্রচারণা চালাবে। এই পর্যায়ে হিন্দু ধর্ম ও মূল্যবোধ যে ভারতের মৌলিক ভাবধারা। কৃষ্ণের উক্তি বা গীতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে এটা করা যেতে পারে বলে প্রস্তাব করেন তিনি। গীতা হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র ধর্মগ্রন্থ।

এর পরের ধাপে, বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদেরকে আক্রমণের প্রস্তাব দেন। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির নেতা রাহুল গান্ধিকে আক্রমণের কথা বলেন তিনি।

সবশেষ ধাপে, চরমপন্থি হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তাদের হিংসাত্মক বিভিন্ন বক্তৃতা ব্যাপকভাবে প্রচার করার প্রস্তাব দেন তিনি। এদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী কয়েকজন হিন্দু ব্যক্তিত্বও রয়েছেন।

শর্মা মিডিয়া কর্মকর্তাদের বলেন, এই ধাপের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোটারদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা যাতে ব্যালট বক্স থেকে বিজেপি লাভবান হয়।

কোবরা পোস্ট যেসব মিডিয়া গ্রুপের কাছে গিয়েছিল তাদের মধ্যে রয়েছে বেনেট কোলম্যান। ভারতের দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকাটি এই মিডিয়া সাম্রাজ্যের অংশ। কেবল ভারতেই নয়, টাইমস অফ ইন্ডিয়া সারা বিশ্বে বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রি হওয়া ইংরেজি দৈনিক।

দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এসক্সপ্রেসও কোবরা পোস্টের অভিযানের লক্ষ্যবস্তু ছিল। এটি ভারতের আরেকটি বৃহৎ ইংরেজি দৈনিক। এর মালিক ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপ, যারা দেশটির সর্বাধিক জনপ্রিয় কয়েকটি নিউজ চ্যানেলেরও মালিক।

কয়েকটি হিন্দি ভাষার পত্রিকা ও আঞ্চলিক মিডিয়া গ্রুপের কাছেও একই রকম প্রস্তাব দেয়া হয়।

কোবরা পোস্ট জানায়, দুই ডজনের বেশি সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে দুটি ছাড়া আর সবাই শর্মার প্রস্তাবের বিষয়ে আগ্রহ দেখায়।

কোবরা পোস্টের ওয়েবসাইটে দেয়া সাক্ষাৎকারের ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, মিডিয়া কর্মকর্তা, সম্পাদক এবং সাংবাদিকরা কিভাবে শর্মার প্রস্তাব বাস্তবায়নে সাহায্য করতে পারেন তা নিয়ে কথা বলছেন।

বেনামে ‘বিজ্ঞাপন’ ছাপানো হেকে শুরু করে টাকা দিয়ে করানো সংবাদ প্রতিবেদন ও বিশেষ প্রতিবেদন প্রচারের প্রস্তাব দেয় কয়েকটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান।

কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জানায় তারা আশ্রমটির উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কয়েকটি ‘বিশেষ দল’ তৈরি করবে। তারা ভাইরাল ভিডিও, জিঙ্গেল, কুইজ এবং ইভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তাব দেয়।

কোবরা পোস্ট ভারতের অন্যতম শক্তিশালী কয়েকটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে খুব ভয়াবহ অভিযোগ এনেছে।

বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশেই এমন অভিযোগের ফলে জাতীয় পর্যায়ে কেলেঙ্কারি রটে যেত, সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় হেডলাইন করা হত এবং জনসাধারণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যেত।কিন্তু ভারতে অল্প কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা এই খবরটি বিস্তারিতভাবে প্রচার করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্য ওয়্যার, স্ক্রল, এবং দ্য প্রিন্ট।

তবে, কয়েকটি বড় মিডিয়া গ্রুপ কোবরা পোস্টের অভিযোগের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

তারা কোনো ধরনের অসৎ কাজে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।

টাইমস অফ ইন্ডিয়া বলেছে, কোবরা পোস্ট যেসব মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে তাদের কেউ অসৎ কাজে সম্মতি দেয়নি এবং কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করেননি।

কোবরা পোস্টের, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রকাশক বেনেট কোলম্যানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভিনিত জৈনের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায় শর্মার প্রস্তাব বিবেচনা করতে কত টাকা লাগতে পারে তা নিয়ে দরদস্তুর করছেন জৈন। প্রথমে জৈন এর জন্য ১৫০ মিলিয়ন ডলার দাবী করেন, শেষ পর্যন্ত তিনি এর অর্ধেক পরিমাণ টাকায় রাজি হন।

ট্যাক্স ফাঁকি দিতে কিভাবে নগদ টাকা লেনদেন করা যায় তা নিয়েও আলোচনা হয়।

বেনেট কোলম্যান দাবী করছে তারা জানতেন শর্মা একজন প্রতারক এবং তাকে ফাঁদে ফেলে তার আসল উদ্দেশ্য ধরার জন্য তারা ইচ্ছা করেই তার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে গেছেন।

ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপও কোনও অসৎ কাজে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেন ধর্ম ও বর্ণবাদের ভিত্তিতে বিভেদ তৈরি করার মতো কোনও কিছু তারা করবেন না।

নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে শর্মার সাথে তাদের বিজ্ঞাপনি কর্মকর্তা কথা বলেছেন, এটা তাদের সম্পাদকীয় কোনো সিদ্ধান্ত বা বক্তব্য নয়। তাদের মধ্যে শুধু বিজ্ঞাপনি প্রচারণার বিষয়ে কথা হয়েছে। তবে, তারা কখনোই সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি করে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন না।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, কোবরা পোস্টের অভিযোগ যথাযোগ্য অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু, ভারতের জাতীয় নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগে তারা ভারতের মিডিয়ার স্বাধীনতা সম্পর্কে মারাত্মক সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ দেশটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার র্যাচঙ্কিংয়ের একদম নিচে রয়েছে, এটা ইতিমধ্যেই ভারতের জাতীয় লজ্জার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

কোবরা পোস্টের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে কোনো সন্দেহই থাকবে না, এই তালিকার আরও নিচের দিকে নেমে যাবে ভারত।

ভারত এখন যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে তা সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে উঠেছে দেশটির অনলাইন নিউজ সাইট স্ক্রল-এর হেডলাইনে ‘কোবরা পোস্ট দেখালো ভারতীয় মিডিয়া ডুবছে, এখন হয় প্রতিরোধ করব, নয়ত ডুবে মরব’।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ



রে