ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২

Alamin Islam

Senior Reporter

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার: বিনিয়োগকারীর কান্না, কারসাজির রাজত্ব

শেয়ারবাজার ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০২৫ এপ্রিল ২১ ১৩:৪১:১৮
ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার: বিনিয়োগকারীর কান্না, কারসাজির রাজত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক: একসময় যেটি ছিল লাখো মানুষের স্বপ্ন পূরণের ঠিকানা, আজ তা পরিণত হয়েছে হতাশার প্রতিচ্ছবিতে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আবারও নেমে এসেছে ধসের ছায়া। আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি বহুবার শোনা গেলেও, ১৪ বছর পরেও বাস্তবতা রয়ে গেছে নির্মম। আর এই পতনের দায়ভার কে নেবে—প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মনে।

এক যুগের বেশি সময় ধরে ‘ধস’ চলছে—কিন্তু কেন?

২০০৯-১০ সালে মধ্যবিত্তের হাজারো পরিবার নিজেদের সঞ্চয় নিয়ে পুঁজিবাজারে এসেছিল ভবিষ্যতের নিরাপত্তা খুঁজতে। ২০১০ সালের ভয়াবহ ধস তাদের সেই স্বপ্ন চুরমার করে দেয়।

আজ ২০২৫—এত বছর পরেও বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বরং সংকট হয়েছে আরও গভীর। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা এর পেছনে দেখছেন ৯টি ভয়ংকর কারণ।

পুঁজিবাজার পতনের ৯টি মূল কারণ

১. নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা ও স্ববিরোধিতা

BSEC এর সাম্প্রতিক কার্যক্রমে দক্ষতার অভাব, স্বচ্ছতার সংকট এবং রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। বিনিয়োগকারীরা যেটি চেয়েছিলেন—একটি ন্যায়ভিত্তিক বাজার—তা আজও অধরা।

২. ম্যানিপুলেটরদের রাজত্ব

একটি সংগঠিত চক্র নিয়মিতভাবে দর বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঠকাচ্ছে। IPO প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এখন নিত্যনৈমিত্তিক।

৩. ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা

খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো বাজারে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে এবং কোনো কোনো সময় নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

৪. লভ্যাংশ নীতির অনিয়ম

অনেক কোম্পানি নিয়মিত লভ্যাংশ না দিয়ে বিনিয়োগকারীদের ঠকাচ্ছে। বাধ্যতামূলক লভ্যাংশ নীতি না থাকায় এটি যেন ‘আইনসিদ্ধ’ অপরাধ হয়ে উঠেছে।

৫. বিচারহীনতার সংস্কৃতি

বারবার কারসাজির অভিযোগ উঠলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। এতে দুষ্টচক্র আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

৬. বিভ্রান্তিকর মিডিয়া ও গুজব

কিছু গণমাধ্যম ও কথিত বিশ্লেষক ভিত্তিহীন মন্তব্য দিয়ে বাজারে বিভ্রান্তি ছড়ায়, যার শিকার হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

৭. প্রযুক্তির দুর্বলতা

ডিএসই ও সিএসই এখনো আধুনিক আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারেনি। ট্রেডিং চলাকালে সার্ভার ডাউন হওয়া সাধারণ ঘটনা।

৮. নতুন ও ভালো কোম্পানির অভাব

আকর্ষণীয় কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসছে না। যারা আসছে, তারা মূলত অর্থ সংগ্রহ করে বাজার থেকে গায়েব হয়ে যাচ্ছে।

৯. রাজনৈতিক অস্থিরতা

নির্বাচন বা উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। সরকার বা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিনিয়োগকারীর জীবন যুদ্ধ: এক মিরপুরবাসীর গল্প

মিরপুরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল হোসেন, ২০১০ সালে তার জীবনের শেষ সঞ্চয় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন। ধসে তিনি হারিয়েছেন প্রায় ৬০% অর্থ। এখন তিনি ঋণের বোঝা বইছেন, পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

আরও পড়ুন:

বিনিয়োগকারীদের জন্য মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের ১০% নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা

‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর এক কোম্পানির শেয়ার

শেয়ারহোল্ডারদের অপেক্ষার অবসান: ৩ কোম্পানির ডিভিডেন্ড সভার তারিখ ঘোষণা

“আমি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার আশা করেছিলাম, আজ আমি নিজেই বাঁচার জন্য লড়ছি।”

তার মতো হাজারো বিনিয়োগকারী আছেন যারা শুধু অর্থ হারাননি, হারিয়েছেন মানসিক শান্তি, আত্মবিশ্বাস, ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন।

পুঁজিবাজার রক্ষায় করণীয়: এখনই সময় বদলের

১. BSEC-কে স্বাধীন ও স্বচ্ছ করা

রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কমিশন গঠন, পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্তি এবং জবাবদিহিতামূলক নীতিমালা জরুরি।

২. দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা

যারা কারসাজি করেছে, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

৩. আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার

ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা ও সার্ভার সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।

৪. বিনিয়োগ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা

স্কুল-কলেজে বিনিয়োগ শিক্ষা চালু করতে হবে। সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

৫. ভালো কোম্পানিকে বাজারে আনতে প্রণোদনা

কর ছাড়, সরকারি সহায়তা ও সহজ শর্তে তালিকাভুক্তির সুযোগ দিতে হবে।

৬. বাধ্যতামূলক লভ্যাংশ নীতি

নিয়মিত লভ্যাংশ না দিলে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

৭. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা

বাজার পরিচালনায় স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

সময় খুব কম, এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সংকট এখন শুধু অর্থনৈতিক নয়—এটি একটি বিশ্বাসের সংকট। আর বিশ্বাস হারালে কোনো বাজার টিকে থাকতে পারে না।

সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারী—সবার সম্মিলিত চেষ্টাতেই সম্ভব এ বাজারকে আবার জাগিয়ে তোলা।

শুধু শেয়ারের দাম নয়, গড়ে উঠুক এক স্বচ্ছ, ন্যায়নিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য পুঁজিবাজার—যেখানে বিনিয়োগ মানেই হবে নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সম্ভাবনা।

আল-আমিন ইসলাম/

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ