ঢাকা, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১

রমজানের শেষ দশকের বিশেষ আমল: আত্মশুদ্ধির স্বর্ণসময়

২০২৫ মার্চ ২১ ১২:০০:০২
রমজানের শেষ দশকের বিশেষ আমল: আত্মশুদ্ধির স্বর্ণসময়

নিজস্ব প্রতিবেদক: রমজান মানেই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের এক অনন্য সফর। পুরো মাসজুড়ে বরকতের ধারা বইলেও শেষ দশক যেন আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত শিখর। এই দশ দিনের প্রতিটি রাত, প্রতিটি মুহূর্ত একজন মুমিনের জন্য সোনার চেয়ে দামী। কারণ, এই সময়েই লুকিয়ে আছে এক মহিমান্বিত রাত— লাইলাতুল কদর, যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। তাই এ সময় মুসলমানরা ইবাদতে আরও বেশি মনোযোগী হন, নিজেদের পরিশুদ্ধ করেন, আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত লাভের জন্য কান্নায় ভিজিয়ে দেন সিজদার মাটি।

এই পবিত্র সময়টিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল উল্লেখ করা হলো—

১. ইতেকাফ: ইবাদতের নিরব কুঞ্জ

রমজানের শেষ দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো ইতেকাফ। এটি এক ধরনের স্বেচ্ছা নির্জনতা, যেখানে একজন মুসল্লি দুনিয়ার ব্যস্ততা ছেড়ে মসজিদে অবস্থান করেন, শুধু আল্লাহর ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে এই আমল অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতেন।

হাদিস:

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, "রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন।" (বুখারি: ২০২৫)

হজরত আয়েশা (রা.) আরও বলেন, "তিনি আমাদেরও শবে কদর তালাশ করতে বলতেন।" (বুখারি: ২০২০)

আজকের ব্যস্ত জীবনে কিছুদিনের জন্য সবকিছু ছেড়ে একান্তভাবে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হওয়া সত্যিই এক অনন্য অভিজ্ঞতা হতে পারে।

২. তওবা ও দোয়া: পাপ মোচনের শ্রেষ্ঠ সুযোগমানুষ ভুলের অতল সাগরে ডুবে থাকে, কিন্তু যারা আল্লাহর কাছে ফিরে আসে, তাঁর দরবারে মাথা নত করে, তারাই প্রকৃত সফল।

হাদিস:

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, "যে ব্যক্তি এই দোয়া পড়ে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন, যদিও সে রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে থাকে।" (তিরমিজি: ৩৫৭৭)

তওবার দোয়া:

أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْعَظِيْم الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ

উচ্চারণ: আসতাগফিরুল্লাহাল আজিম, আল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুমু ওয়া আতুবু ইলাইহি।

অর্থ: "মহান আল্লাহর কাছে আমি ক্ষমা চাই, যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; যিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং আমি তাঁর কাছে তওবা করি।"

এটি শুধুমাত্র শব্দ নয়, বরং আত্মার গভীর থেকে আসা এক অনুশোচনা, যা মানুষকে আল্লাহর প্রিয় করে তোলে।

৩. বেশি বেশি ইবাদত: আল্লাহর নৈকট্য লাভের সোপানরমজানের প্রথম বিশ দিনও গুরুত্বপূর্ণ, তবে শেষ দশক যেন ইবাদতের মহোৎসব। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই সময় স্বাভাবিক দিনের চেয়ে বেশি ইবাদতে মগ্ন থাকতেন।

হাদিস:

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, "রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে এত বেশি ইবাদত করতেন, যা বছরের অন্য সময়ে করতেন না।" (মুসলিম: ১১৭৫)

তিনি আরও বলেন, "এই সময়ে তিনি নিজের রাত জাগরণ করতেন, পরিবারকেও জাগিয়ে তুলতেন।" (বুখারি: ২০২৪)

সেহরির নিস্তব্ধ রাতে, নির্জনতার মাঝে যখন একজন বান্দা কুরআনের আয়াত আবৃত্তি করে, তখন আসমানের ফেরেশতারাও তার জন্য রহমতের দোয়া করেন।

৪. শবে কদর অনুসন্ধান: ভাগ্য বদলের রাতরমজানের শেষ দশকের এক অনন্য রহস্য হলো লাইলাতুল কদর, যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। কিন্তু এই রাত নির্দিষ্ট নয়, তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর খুঁজতে।

হাদিস:

"যে ব্যক্তি কদর রাতের সন্ধান করতে চায়, সে যেন রমজানের শেষ দশকে তা খুঁজে নেয়।" (বুখারি: ১১৫৮)

এই রাতে পড়ার জন্য বিশেষ দোয়া শিখিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)—

শবে কদরের দোয়া:

اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাআফু আন্নি।

অর্থ: "হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাকারী, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। অতএব, আমায় ক্ষমা করুন।" (তিরমিজি: ৩৫১৩)

এই রাতই হয়তো আমাদের জীবনের শেষ শবে কদর! তাই এর প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদতে কাটানোই বুদ্ধিমানের কাজ।

৫. সদকাতুল ফিতর: দানশীলতার সৌন্দর্যরমজানের শেষ দশকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো সদকাতুল ফিতর। এটি শুধু দানের একটি মাধ্যম নয়, বরং গরিব-দুঃখীদের জন্য ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার এক সুযোগ।

হাদিস:

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, "সদকাতুল ফিতর রোজাদারের রোজার অপূর্ণতা দূর করে এবং গরিবদের খাবারের ব্যবস্থা করে।" (আবু দাউদ: ১৬০৯)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে সাহাবিরা এক সা (প্রায় সাড়ে তিন কেজি) খাদ্যশস্য, যব, খেজুর, কিসমিস, বা পনির সদকা করতেন। (বুখারি: ১৫০৫)

বর্তমান সমাজে যারা সামর্থ্যবান, তাদের উচিত সর্বনিম্ন হার নয়, বরং সম্ভব হলে বেশি পরিমাণে দান করা।

রমজানের শেষ দশক শুধু ইবাদত করার সময় নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধির এক স্বর্ণালী অধ্যায়। এই সময়ে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত, তওবা, দান-সদকা ও শবে কদরের অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারি।

আসুন, আমরা সবাই এই শেষ দশকের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাই, আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত লাভের আশায় নিবেদিত হই এবং ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য গরিব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়াই। হয়তো এটাই আমাদের জীবনের শেষ রমজান!

আব্দুর রহিম/

ধর্ম - এর সব খবর

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ