ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

হঠাৎ সৌদি রাজপরিবারে মতবিরোধ

প্রবাসী ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০২০ সেপ্টেম্বর ৩০ ১৯:২০:১৮
হঠাৎ সৌদি রাজপরিবারে মতবিরোধ

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সৌদি রাজপরিবার এবং সরকারের প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির সাম্প্রতিক বক্তব্য, বিবৃতি এবং ক্ষমতাধর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মৌনতা দেখে মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্লেষকরা বলতে শুরু করেছেন যে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সৌদি আরব এখনও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে।

তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই চাপাচাপি করুন আর যুবরাজ মোহাম্মদ যতই উৎসাহী হোন না কেন, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন এখনই হচ্ছে না।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির বিশেষজ্ঞ নায়েল শামা বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা নিয়ে সৌদি রাজপরিবারের ভেতর এখনও যে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার মতে, ‘ক্ষমতাধর যুবরাজ বিন সালমান দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন, কিন্তু তার বাবা বাদশাহ সালমান এখনও দ্বিধায় রয়েছেন।’

সেই দ্বিধার প্রথম লক্ষণ দেখা গেছে গত ২৩ সেপ্টেম্বর যখন বাদশাহ সালমান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তার ভাষণে পরিষ্কার বলেন যে, সৌদি আরব এখনও ২০০২ সালের আরব শান্তি পরিকল্পনার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তিনি বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তখনই সম্ভব, যখন তারা পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী মেনে নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাজি হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা নিজের ছেলের ইচ্ছার তোয়াক্কা যে সৌদি বাদশাহ করছেন না, তার আরও নমুনা চোখে পড়ছে।

সৌদি রাজপরিবারে বিভেদপ্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল গত সপ্তাহে তাদের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্নে সৌদি রাজপরিবারে বিভেদ দেখা দিয়েছে।

পত্রিকাটির দাবি, চুক্তির আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলি এবং আমেরিকান কর্মকর্তাদের মধ্যে গোপন দেন-দরবার, দর কষাকষির ব্যাপারে সমস্ত কিছু সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ জানলেও বাবার কাছে তিনি তা গোপন রাখেন।

মার্কিন আরেক প্রভাবশালী সাময়িকী টাইমের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, বাদশাহ সালমান ক্ষিপ্ত হতে পারেন এই ভয়ে বাহরাইন চুক্তি করতে ইতস্তত করছিল, কিন্তু যুবরাজ মোহাম্মদ তাদের আশ্বস্ত করেন।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানাচ্ছে, বাদশাহ সালমান এ নিয়ে ছেলের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও জেরুজালেম নিয়ে সৌদি প্রতিশ্রুতি নতুন করে তুলে ধরার জন্য তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি নির্দেশ দিয়ে দেন।

তাই আগস্টে আমিরাত সিদ্ধান্ত জানানোর পরপরই সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সল বিন ফারহান জার্মানিতে এক সফরে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ফিলিস্তিন সঙ্কট সমাধানের ইস্যু অগ্রাহ্য করার প্রশ্নই আসে না।

গত সপ্তাহে সৌদি রাজপরিবারের প্রভাবশালী সদস্য, সাবেক গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সল সৌদি দৈনিক আশরাক আল আওসাতে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে যাওয়ার কথা বিবেচনা করছে এমন যে কোনো আরব দেশের উচিত ‘(ইসরায়েলের কাছে) উঁচু মূল্য দাবি করা’।

বাদশাহ সালমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিতি প্রিন্স তুর্কি আরও লিখেছেন, ‘সৌদি আরব একটি দাম ধার্য করেছে। আর তা হলো, ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে— যার রাজধানী হবে জেরুজালেম।’

পর্দার আড়ালের সম্পর্কমধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব কমতে থাকা এবং সেই সঙ্গে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নিয়ে সৌদি আরব আতঙ্কিত। সৌদি বাদশাহ এখন মুখে যত কথাই বলুন না কেন, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পর্দার আড়ালে তার সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।

কিন্তু সেই সম্পর্ককে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২০১৮ সালের এপ্রিলে যুবরাজ বিন সালমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়। সৌদি যুবরাজ সেখানে মার্কিন ইহুদি নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে খোলাখুলি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করে বলেন, দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের নমনীয় হতে হবে।

ওই বৈঠক নিয়ে সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যম লেখা হয়, সৌদি যুবরাজ খোলাখুলি বলেন যে, ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধান সৌদি আরব চায়, কিন্তু ‘ইরানের মোকাবিলা এখন তাদের কাছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার।’পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং উপসাগরীয় আরব শাসকদের অনেকেই এখন মনে করছেন, ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে বসে থাকা সময়ের অপচয় এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী। ইরানকে ঠেকানো এবং প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ককে তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে যুবরাজ বিন সালমান ‘ভিশন-২০৩০’ নামে যে পরিকল্পনা নিয়েছেন, ইসরায়েলকে তার অংশীদার করতে তিনি আগ্রহী।

সৌদি বাদশাহর দ্বিধা কেনকিন্তু তারপরও সৌদি রাজপরিবার ও শাসকদের একাংশের মধ্যে এমন দ্বিধা কেন?

ড. নায়েল শামা বলছেন, দৃষ্টিভঙ্গির ‘প্রজন্মগত’ পার্থক্য যেমন রয়েছে, তেমনই এর পাশাপাশি ইসলামি দুনিয়ায় নেতৃত্ব ধরে রাখা নিয়ে সৌদি রাজপরিবার ও সৌদি রাষ্ট্রের প্রভাবশালী বিরাট একটি অংশের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।

এই অংশটি মনে করে, ফিলিস্তিনি স্বাধিকার, জেরুজালেম এবং আল-আকসা মসজিদের ওপর আরবদের নিয়ন্ত্রণের ইস্যুতে আপোষ করলে মক্কা ও মদিনার মসজিদের রক্ষক হিসাবে বিশ্বের মুসলমানদের কাছে সৌদি রাজপরিবার বা সৌদি আরবের গ্রহণযোগ্যতা হুমকিতে পড়বে।

তিনি বলেন, ‘ইসলামি নেতৃত্বের ঝাণ্ডা ধরে রাখাকে সৌদি রাজপরিবার গুরুত্ব দেয়। তারা মনে করে এই প্রভাব তাদের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক অস্ত্র। সংযুক্ত আরব আমিরাত বা বাহরাইনের এমন কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।“

এ ছাড়াও তিনি বলেন, আমিরাতের বর্তমান শাসকরা যেমন তাদের সমাজ ও রাজনীতি থেকে ইসলামি প্রভাব ঝেড়ে ফেলতে উন্মুখ, ‘সৌদি রাজপরিবার এখনও তেমনটা একেবারেই ভাবে না।’ সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইসলামি বিশ্বে নেতৃত্ব নেয়ার জন্য তুরস্কের রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের নতুন আকাঙ্ক্ষা।

সৌদি জনমতপাশাপাশি অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, বিনিময়ে কোনো কিছু আদায় না করে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া সাধারণ সৌদিদের মধ্যেও গ্রহণযোগ্য হবে না— এ নিয়েও সৌদি রাজপরিবারের একাংশের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।

সৌদি জনমতের কিছুটা আঁচ পাওয়া গেছে আমিরাত-বাইরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তির দিন। ওয়াশিংটনে ১৫ সেপ্টেম্বর চুক্তির পরপরই ‘এই স্বাভাবিক সম্পর্ক বিশ্বাসঘাতকতা’ এমন টুইটার হ্যাশট্যাগ সৌদি ঝড় ওঠে।একই সঙ্গে টুইটারে বহু পুরনো একটি ভিডিও ফুটেজ পোস্ট করার পর অসংখ্য সৌদি তাতে লাইক দিয়েছেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রয়াত সৌদি বাদশাহ ফয়সল ক্রুদ্ধ স্বরে বলছেন, ‘সমস্ত আরব বিশ্বও যদি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়, ফিলিস্তিনের বিভক্তি মেনে নেয়, সৌদি আরব তার সঙ্গে কখনোই গলা মেলাবে না।’

ওই ভিডিও ফুটেজে বাদশাহ ফয়সলের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বর্তমান বাদশাহ সালমান।

অনেকের ধারণা ফিলিস্তিন ইস্যুতে কোনো ছাড় না পেয়েও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকে ৮৪ বছর বয়সী বাদশাহ সালমান হয়ত ব্যক্তিগতভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তবে জনমতের বিবেচনা খুব বেশি কাজ করছে বলে মনে করছেন না ড. নায়েল শামা।

তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে সৌদি জনগণের সিংহভাগই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আদৌ উৎসাহী নন। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সংস্কৃতি দেশটিতে নেই। এই অবস্থার পরিবর্তন যে হবে, সে সম্ভাবনাও অদূর ভবিষ্যতে নেই।“

সৌদি বাদশাহ কি ফাঁকা দাবি করছেন?

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নিয়ে সৌদি বাদশাহ গোঁ ধরে রয়েছেন, তা কতটা যৌক্তিক? ইসরায়েল কি এখন তাতে আদৌ কান দেবে, বিশেষ করে যখন বহু আরব দেশের কাছে ইরান এখন তাদের চেয়েও বড় শত্রু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে?

লন্ডনে গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ এল-দাহশান— যিনি নিজে জাতিসংঘে চাকরির সূত্রে দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েলে ছিলেন— তিনি বিবিসিকে এ প্রসঙ্গে বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ফিলিস্তিনিরাই এখন আর দেখছেন না।

তিনি আরও বলেন, ‘পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে এখনও প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ইহুদি বসতি তৈরি হচ্ছে। ওই সব বসতিতে ইহুদি জনসংখ্যা ইতোমধ্যে আট লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ওই সব বসতি রক্ষার নামে ফিলিস্তিনি জনবসতির মধ্যে দেয়ালে পর দেয়াল উঠেছে। গাজা ভূখণ্ড এখন একটি কারাগার।’

তিনি বলেন, ‘এর ফলে ফিলিস্তিনিরা বুঝে গেছে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন হয়তো আর সম্ভব নয়। তাদের নেতারা মুখে না বললেও বাস্তবতা বুঝতে পারছেন।’

ড. নায়েল শামাও মনে করেন, বাদশাহ সালমানের দাবি অনেকটাই অসাড়, কারণ ‘আরব শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা এখন সুদুর পরাহত।’

তার মতে, ‘আরব বিশ্বের রাজনীতিতে সারবস্তুর চাইতে বাগাড়ম্বর বেশি। ইয়েমেনের যুদ্ধ, সাংবাদিক জামাল খাসোগের হত্যা আর অর্থনৈতিক সঙ্কটে সৌদি আরব ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। দেশের ভেতর এবং বাইরে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখা সৌদি রাজপরিবারের জন্য এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

বাদশাহ সালমান হয়ত সেই বিবেচনাতেই সতর্ক থাকতে চাইছেন। নায়েল শামা মনে করেন, বাদশাহ সালমানের ক্ষমতা শেষ হলে খুব দ্রুতই ইসরায়েলের ব্যাপারে সৌদিদের কাছ থেকে পদক্ষেপ দেখা যাবে।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ



রে