ঢাকা, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১

লকডাউনে থমকে যাওয়া মালয়েশিয়ার যে সব অঞ্চল ফিরতে শুরু করেছে আগের রূপে

বিশ্ব ডেস্ক . ২৪আপডেট নিউজ
২০২০ মে ১৮ ২১:৩৩:৫৯
লকডাউনে থমকে যাওয়া মালয়েশিয়ার যে সব অঞ্চল ফিরতে শুরু করেছে আগের রূপে

বহুদিনের ইচ্ছা আর স্বপ্ন সঙ্গে নিয়ে আল্লাহপাকের অশেষ মেহেরবানিতে গত বছর জুলাইয়ে নয়নাভিরাম পেনাং দ্বীপে অবস্থি”ত বিখ্যাত ‘ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স মালয়েশিয়ার স্কুল অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিএইচডি শুরু করি।কোর্স রেজিস্ট্রেশন, স্টুডেন্ট পাস ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতার পর রিসার্চ ওয়ার্ক, পেপার লিখা, জার্নাল স্টাডি আর বিভিন্ন ওয়ার্কশপে যোগদান এই নিয়ে দিনগুলো আল্লাহপাকের মেহেরবানিতে ভলোভাবেই কেটে যাচ্ছিল।

এরপর আচমকাই করোনাভাইরাসের আগমন আর স্বাভাবিক সবকিছুতে ছন্দপতন। যদিও জানুয়ারি মাসেই মালয়েশিয়ায় প্রথম সংক্রমন ধরা পড়ে। কিন্তু আউটব্রেক হঠাৎ সামনে আসে ১৫ মার্চ।১৬ মার্চ জরুরি সভা, অতপর ১৭ মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় লকড ডাউন। দ্রুতগতির চলমান গাড়ি হঠাৎ হার্ড ব্রেক করে দাঁড়িয়ে গেলে সবাই যেমন ঝাকি খেয়ে হতবিহ্বল হয়ে যায়, আমাদের অবস্থা ঠিক যেন তেমনটাই হয়ে গেল। ১৬ তারিখ বিকেল থেকেই হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ আসতে শুরু করে আর ১৭ তারিখ সকালে ভার্সিটি গিয়ে গিয়ে দেখি গেট বন্ধ!

জানলাম শুধু মেইন গেট খোলা থাকবে আজ থেকে, মানে অনেকটা ঘুরে যেতে হবে। আসলে কী হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে তা তখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। মেইন গেটের কাছে যেতেই সিকিউরিটি আমাদের আইডি কার্ড চেক করে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মেপে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেয়। এরপর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখলাম ল্যাব বন্ধ, আর চেনা পরিবেশটা আজ হঠাৎ কেমন অচেনা মনে হতে লাগল।

কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না, যেন এক চাপা উত্তেজনা সবখানে। অস্থির মন নিয়ে আমার নির্ধারিত পোস্ট গ্রাজুয়েট রুমে গিয়ে বসলাম। আজ এখানেও কলিগদের উপস্থিতি একেবারেই কম। কোন কাজেই মন বসছে না। একটু পরেই আরও খারাপ খবর নিয়ে আসলেন আমাদের ডেপুটি ডিন। বললেন পাশের ম্যাটেরিয়াল স্কুলের এক শিক্ষক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, কাজেই সব স্কুল লকড ডাউন থাকবে আর আমাদের এখনি পোস্ট গ্রাজুয়েট রুমও ছেড়ে দিতে হবে।

অগত্যা পোস্ট গ্রাজুয়েট রুমের জিনিসপত্র গুছিয়ে সুপারভাইসর স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সার্বিক অবস্থা জানিয়ে স্যারের কাছ থেকে একরকম বিদায় নিয়ে পথে এক মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে হোস্টেলে এসে উঠলাম। আছর, মাগরিব, এশার নামাজ পাশের মসজিদে গিয়ে আদায় করলাম প্রতিবারই গেটের রেজিস্টার খাতায় নাম লিখে।

আজ মসজিদে মুসুল্লি একেবারেই কম। কোথাও কোন প্রাণচাঞ্চল্য নেই অন্যদিনের মতো। এক চাপা উত্তেজনা আর অজানা শত্রুর আতংক মনে হয় ঘিরে আছে সব জায়গায়। রাতে মন খারাপ অবস্থায়ই কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ফজরের নামাজের জন্য তৈরি হয়ে নিচে নেমে দেখলাম ডরমিটরির গেট বন্ধ। সিকিউরিটি বললেন সরকারের নির্দেশ মোতাবেক পুরো মালয়েশিয়া এখন থেকে লকড ডাউন, যেটাকে ওরা বলছে ‘মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার (এমসিও)।

কাজেই হোস্টেল গেটও পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। নামাজ রুমেই পড়তে হবে। এবছর ১৮ মার্চ শুরু হল জীবনে প্রথমবারের মত সত্যিকারের বন্দিত্বের স্বাদ, যা এখনও চলছে। এদিকে যারা দেশে বা তাদের নিজেদের বাসায় ফিরতে চায় সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় ১৮ ও ১৯ মার্চ দুই দিনের সময় দেয় সবাইকে। এই সুযোগে অনেকেই দেশে ফিরে গেলেও ধর্মীয় বিধান অনুসারে এখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিই।

তবে এই বন্দিত্ব যেন মহান আল্লাহ্পাকের রহমতে অভাবনীয় এক দরজা খুলে দিল। কথায় বলে বি”পদে মানুষ চেনা যায়। কথাটার সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম এই করোনাভাইরাসের উদ্ভুত লকডাউনে। প্রথমেই চিন্তায় পড়লাম খাবারের কি ব্যবস্থা হবে। কারণ আমাদের ডরমিটরিটা মূল ক্যাম্পাস থেকে বেশ খানিকটা দূরে। যাদের নিয়মিত ক্যাম্পাসে যেতে হয় তারা ক্যাম্পাস কেন্টিনেই খাবার খেয়ে নেয়, আমিও এতদিন তাই করতাম।

ডরমিটরির আশপাশে খাবারের কোন দোকানও নেই। গেট বন্ধ থাকলে খাবারের কি ব্যবস্থা এরকম নানা চিন্তা আর দুশ্চিন্তার মধ্যেই কিছু ভাই এসে আমাদের তথ্য নিয়ে গেল আর একটু পর দেখলাম হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ওপেন করেছে যারা এই সময় এখানে আছে তাদের জন্য। আল্লাহপাকের মেহেরবানিতে এরপর আস্তে আস্তে সব দুশ্চিন্তা দূর হতে থাকে এই বিপদে মালয়েশিয়া সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাপকভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য যা সারাজীবন ভুলার নয়। বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সবাইকে ৪৫০ রিংগিট সমমানের খাবার কুপন দেয়, দিনে দুইবার গাড়ি দিয়ে ক্যাম্পাস কেন্টিন থেকে খাবার আনার ব্যবস্থা করে, ছাত্রদের পরীক্ষা করে কারও কোন শারীরিক অসুবিধা থাকলে সঙ্গে সঙ্গে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ইত্যাদি।

আমাদের ক্যাম্পাস ডিরেক্টর, ডেপুটি ভিসি, ডেপুটি ডিন প্রায় প্রতিদিন বিভিন্নভাবে আমাদের খোঁজ খবর রাখেন। এর মধ্যে একদিন মালয়েশিয়ার শিক্ষা উপমন্ত্রী এসে দেখা করে আমাদের খোঁজ খবর নেন আর সবাইকে নিয়ে দোয়া করেন। এসব বড় মাপের মানুষরা দেখা হলেই কতবার যে ‘সরি বলতেন আমাদের হয়ত কষ্ট হচ্ছে এজন্য। ভিসি মহোদয় তিনদিন উনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছেন রোজার আগে।

রোজার ৭ দিন আগে বিশ্ববিদ্যায়ের পক্ষ থেকে প্রত্যেক ছাত্রদের বড় এক গিফট ব্যাগ দেয়া হয় যার ভিতর বিভিন্ন ধরনের শুকনো খাবার, ব্রাশ, পেস্ট, হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজার সঙ্গে আরও কিছু জিনিস ছিল। পুরো রমজান মাসের প্রতিদিন আমাদের জন্য ইফতার আর সেহরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদের রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবক ভাই বিকেল ৭টার মধ্যে ইফতার আর রাত ১২টায় সেহরি ডরমিটরিতে পৌঁছিয়ে দিয়ে যায়।

এই এমসিও এর ভিতর যদিও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, কিন্তু অনলাইনে সব অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চলছে। প্রশাসন থেকে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যেন কারও সময় নষ্ট না হয়। ভিসি মহোদয় ফেইসবুক লাইভে মিটিং করে সবার কথা শুনেন আর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আগামী ৬ মাসের কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি এসময় প্রচুর রিসার্চ বেসড উইবিনার, ভিডিও কনফারেন্স, ইউটিউব টিউটোরিয়ালের ব্যবস্থা করে যা এ লক ডাউনের সময়টা আমাদের জন্য উপভোগ্য করে তুলে এবং সবাই বিশেষভাবে উপকৃতও হয়েছে।

কাল কর্তৃপক্ষ ফরম পাঠিয়ে জানতে চেয়েছে রোজার সেহরি ইফতারের মান ঠিক আছে কিনা আর পরবর্তীতে আমাদের কী খেতে মন চায়। এদের এ সহমর্মিতা আর আপ্যায়নে দেশী বিদেশি সবাই আমরা সত্যিই অভিভূত, সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করেছে এই দেশ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। আর তারই পুরস্কার স্বরূপ মনে হয় গত ১৫ দিনে এই প্রদেশে কোন নতুন রোগী নেই, যার কারণে সরকার একে ‘গ্রিন জোন ঘোষণা করেছে।

নিশ্চয় একদিন করোনাভাইরাস বিদায় হবে আল্লাহপাকের হুকুমে আর আমাদের পড়াও শেষ হবে, ফিরে যাবো নিজ দেশে। তবে বাইরের প্রতিষ্ঠানের এই ব্যবস্থাপনা শিক্ষাটাই মনে হচ্ছে জীবনে সবচেয়ে বড় অর্জন হয়ে থাকবে, সুযোগ পেলে যা নিজের প্রিয় দেশে কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।লেখক: পিএইচডি, রিসার্চ ফেলো, স্কুল অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স, পেনাং, মালয়েশিয়া।

বিশ্ব - এর সব খবর

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ